• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৩ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

রায়হান হত্যা : গ্রেপ্তার নেই, বাড়ছে ক্ষোভ

admin
প্রকাশিত অক্টোবর ১৭, ২০২০
রায়হান হত্যা : গ্রেপ্তার নেই, বাড়ছে ক্ষোভ

অতিথি প্রতিবেদক :: রায়হান হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যরা আইনের আওতায় না আসায় ক্ষোভ কমছে না সিলেটে। আলোচিত এ খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করা হয়নি। কেউ জানে না এই মামলার আসামি কারা। তদন্ত সংস্থা পিবিআই বলছে, তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে ঘটনার চারদিন পর বুধবার রাতে রায়হানের নেহারীপাড়াস্থ বাসায় গিয়েছেন সিলেটের পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া।

তিনি জানিয়েছেন, আকবর ছাড়া অন্যরা মহানগর পুলিশের কাছে রয়েছে। পিবিআই যখন চাইবে তাদের দেয়া হবে। গত রোববার ভোররাতে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ঘটে আলোচিত রায়হান খুনের ঘটনা।

নগরীর কাস্টঘর থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে নিয়ে আসে। রাত ৩টার পর রায়হানকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে পুলিশ। রায়হানের হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়। হাঁটুর নিচে পায়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। হাত এবং আঙুল থেঁতলে দেয়া হয়েছে। এই নির্যাতনের বিবরণ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের কাছে দিয়েছেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরতউল্লাহ রেস্ট হাউসের বাসিন্দা হাসান খান। একই সঙ্গে ওইদিন পুলিশের টহলের সঙ্গে থাকা সিএনজি অটোরিকশা চালকও ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

দুই দফা ময়নাতদন্ত করা হয়েছে রায়হানের মরদেহের। প্রথমটি করা হয়েছে ঘটনার দিন রোববার দুপুরে। এরপর ‘হেফাজতে’ মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় দ্বিতীয় দফা সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কবর থেকে উত্তোলন করা হয় রায়হানের মরদেহ। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহাল রিপোর্ট করার জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়।

ময়নাতদন্তের পর টিমের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, নির্যাতনেই মারা গেছে রায়হান উদ্দিন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। শরীরের অভ্যন্তরে আঘাতের চিহ্ন বেশি থাকায় সে মারা যায়। এরপরও অধিকতর তদন্তের জন্য তারা কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন। সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য চট্টগ্রামের ল্যাবে পাঠানো হবে।

ফাঁড়িতে নির্যাতনের ঘটনার পর আলোচিত এ ঘটনাটি ‘গণপিটুনি’ বলে দাবি করেছিল সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তদন্তে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী এসপি অফিসের ফটকের সিসিটিভি ফুটেজে দেখে গেছে রাত ৩টার পর সিএনজি অটোরিকশায় করে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল রায়হানকে। এরপর সকাল সাড়ে ৬টার পর তাকে ‘গুরুতর’ অবস্থায় সিএনজি অটোরিকশাতে তুলে হাসপাতালে নেয়া হয়।

এই সিসিটিভি ফুটেজ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের কাছে এসেছে। সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ার পর নির্যাতনে জড়িত থাকা এক পুলিশ সদস্য মুখ খোলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের কাছে। জানান, রায়হানকে ধরে এনে ফাঁড়িতে নির্যাতন করা হয়েছে।

এ কারণে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই রায়হানসহ তিন কনস্টেবলকে তাৎক্ষণিক সাময়িক বহিষ্কার ও তিনজনকে ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জল্পনা শুরু হয় বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই রায়হানকে ঘিরে।

কিন্তু ঘটনার পরপরই গণপিটুুনির নাটক সাজিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। ঘটনার ৫ দিন পরও তার কোনো খোঁজ মিলছে না। কেউ বলছেন, সে সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছে। তবে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই বৃহস্পতিবার এসআই রায়হান যাতে সীমান্ত দিয়ে পালাতে না পারে সে কারণে দেশের সব ইমিগ্রেশন ও চেকপোস্টে বার্তা পাঠিয়েছে। রায়হানের খুঁজে আশুগঞ্জের বেড়তলা এলাকার বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালালেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। রায়হান পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায়ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সিলেটে। ঘটনার পরপরই কেন রায়হানকে আটকে রাখা হলো না- সে প্রশ্ন এখন সবার।

তবে সিলেট মহানগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলার পর রায়হানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকা ছেড়ে সে যেন বাইরে বের না হয়। এর পরও ঘটনার পর বন্দরবাজার সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ও আলামত গায়েব করে পালায় এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। এখন পর্যন্ত পুলিশ তার খোঁজ পায়নি।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে নিহত রায়হানের বাড়িতে গিয়ে এ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া। এর আগে তিনি নিহত রায়হানের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। ন্যায় বিচারের স্বার্থে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ পরিবারের পাশে থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন।

পুলিশ কমিশনার এ সময় সাংবাদিকদের জানান, ‘এসআই আকবর যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে এ জন্য সব সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আকবর ছাড়া রায়হান হত্যার ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হওয়া সকল পুলিশ সদস্য আমাদের কাছে রয়েছে। পিবিআই চাইলে যেকোনো সময় এদেরকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলায় আমরা পিবিআইকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। ন্যায় বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমরাও কাজ করছি।’ এরপর সিলেট জেলা প্রশাসকের একটি প্রতিনিধি দল রায়হানের বাসায় গিয়েও সান্ত্বনা দেয়। এ সময় রায়হানের স্ত্রী তামান্না আক্তার তান্নীর কাছে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। এদিকে গত বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তভার গ্রহণ করলেও সিলেটের পিবিআয়ের পক্ষ থেকে গতকাল পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। তবে থানা হেফাজতে মৃত্যুর অনেক তদন্ত এরই মধ্যে এগিয়ে রেখেছে এ তদন্ত সংস্থা।

পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মো. খালেদুজ্জামান জানিয়েছেন, তদন্তকালে যাদের না পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

এদিকে, ঘটনার ৫ দিন পেরিয়ে গেলেও আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় সিলেটে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ নিয়ে চলছে লাগাতার আন্দোলন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, পুলিশের উচিত ছিল ঘটনার পরদিনই এ ব্যাপারে প্রেস ব্রিফিং করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা। কিন্তু পুলিশ তা করেনি। ইতিমধ্যে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিষয়টি পরিষ্কার হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

একুশেনেট/শামীম