ডেস্ক:: ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) পুলিশ লাইন্সের (সশস্ত্র) রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) আবদুস সালাম ও কেন্দ্রীয় রিজার্ভ অফিসার-১ (আরও-১) এসআই (নি.) মো. খায়রুদ্দিন। অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের ডাক ও এসকর্ট ডিউটি, বিভিন্ন গার্ড, ক্যাম্পে ফোর্স মোতায়েন, বিভিন্ন ধরনের ফান্ডে নিয়োগ, সিএল ও এলএপি ছুটি, পিডি ও টিএ বিল-সব কাজেই টাকা দিতে হয় সালামকে। টাকা না দিলে কাজ তো মেলেই না; বরং পড়তে হয় দুর্ভোগে। আর ফোর্সের ছুটি, বদলির আবেদন অগ্রগামী, স্বেচ্ছায় ট্রেনিংয়ের জন্য আবেদনকারী, বিভাগীয় মামলা/লিখিত অভিযুক্তরা টাকা না দিলে কাজ করেন না (আরও-১) খায়রুদ্দিন। শুধু তা-ই নয়, ফাঁড়ির ইনচার্জ, থানা ও ফাঁড়ির ক্যাশিয়ার, মুনশি ও কম্পিউটার অপারেটরদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন তিনি। এই দু’জনই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন এ ধরনের অনিয়ম করে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেয়া হয় না; বরং অভিযোগকারীকে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ এসএমপির সব ফোর্স ও অফিসার। সালাম ও খায়রুদ্দিনকে খুশি না করে পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নিয়েছেন এমন ফোর্স-অফিসার নেই পুরো এসএমপিতে। এসএমপির একাধিক অফিসার ও ফোর্স যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। সালাম ও খায়রুদ্দিনকে ঘুষ দেয়ার অসংখ্য অডিও ক্লিপ রয়েছে যুগান্তরের কাছে।
আবদুস সালামের ঘুষ-দুর্নীতি : অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই এসএমপির পুলিশ লাইন্সের (সশস্ত্র) রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) হিসেবে যোগদান করেন কুমিল্লার আবদুস সালাম।
যোগদানের পর থেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন। তার অনিয়মে অতিষ্ঠ হয়ে চলতি বছরের জুনে এসএমপি কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও উপকমিশনার (ডিসি হেডকোয়ার্টার্স)-সহ ১১ কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে অডিও ক্লিপ পাঠিয়ে অভিযোগ করেন কনস্টেবল (২৪১৪) দ্বীপ কুমার বিশ্বাস। এ ঘটনায় চলতি বছরের ১১ জুন দ্বীপ কুমার বিশ্বাসসহ সাক্ষীদের লিখিত জবানবন্দি নেয়া হয়। দ্বীপ কুমার বিশ্বাসের জবানবন্দির কপিও রয়েছে যুগান্তরের হাতে। কিন্তু আরআই সালামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো দ্বীপকে হাইওয়ে পুলিশে বদলি করা হয়। সালাম নিজের পছন্দমতো পুলিশ সদস্যদের ডাক ও এসকর্ট ডিউটি দেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ডিউটিপ্রতি এক হাজার টাকা ঘুষ নেন। টাকার বিনিময়ে পুলিশ লাইন্সের এএসআই (এবি) মনিরুল, সোহেল সারোয়ার, এটিএসআই মো. আলাউদ্দিন, নায়ক মহরম, মো. ইমরান খান, নাইমুর রেজা, আলাউদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, আবদুল কাদের, কনস্টেবল সজিবুল ইসলাম, দ্বীপ কুমার বিশ্বাস (তাকে বদলি করা হয়েছে), মেহরাজ আহমেদ, মিঠুন কিবরিয়া, মো. মিনহাজুল ইসলাম, মামুন, মো. জুনাইদ, আল আমিন, মো. আসাদুজ্জামান, আল ফরিদ, শাখাওয়াত হোসেন-এই কয়েকজনকেই ঘুরেফিরে ডাক ও এসকর্ট ডিউটি দেন সালাম। একইভাবে এক হাজার টাকার বিনিময়ে কালাগুল পুলিশ ক্যাম্পে ডিউটি দেন। সেভরনে পুলিশ গার্ডের দায়িত্ব দেন জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকায়। সেভরন কোম্পানি প্রতি কনস্টেবলকে মাসে ৪৮০০ টাকা, নায়েক/এএসআই-কে ৫২০০ টাকা করে বিল দিলেও সালাম প্রতি বিল থেকে এক হাজার টাকা রেখে দেন। সোনালী ব্যাংক গার্ড, ট্রেজারি গার্ড, টিভি সেন্টার গার্ড, বৌদ্ধবিহার গার্ড ও শাবিপ্রবির ভিসির বাংলোয় গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হলে এক হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। পুলিশ লাইন্সের ভেতরে ডি-স্টোর, সি-স্টোর, রেশন-স্টোর, মেজর অফিস, আরআই অফিস, এমটি সেকশন ও বডিগার্ড ডিউটিসহ সব ফান্ডে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পেতে জনপ্রতি ৫-১৫ হাজার টাকা দিতে হয় সালামকে। তাছাড়া যেখানে একজন এলসির প্রয়োজন, সেখানে ২-৩ এলসি নিয়োগ করে রাখেন সালাম। পুলিশ লাইন্সে কর্মরত সদস্যদের সিএল ছুটির জন্য দুই শ ও এলএপি ছুটির জন্য পাঁচ শ টাকা দিতে হয়। সিনিয়র অফিসাররা যেসব পুলিশ সদস্যের বিভিন্ন অনিয়মের জন্য শাস্তিমূলক পিডি প্রদান করেন, তাদের কাছ থেকে ১-১০ হাজার টাকা নিয়ে পিডি না খাটিয়ে কাগজে-কলমে খেটেছেন বলে দেখিয়ে দেন। এছাড়া টিএ বিল উত্তোলনের জন্য আরআই সালামের কাছে গেলে তিনি ইচ্ছামতো টাকা কেটে রাখেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমপি পুলিশ লাইন্সের (সশস্ত্র) রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) আবদুস সালাম বলেন, এসব মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগ। কাউকে দায়িত্ব দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমি ম্যানেজ করব কেন? কনস্টেবল দ্বীপ কুমার বিশ্বাস অভিযোগ দিয়ে থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন।
খায়রুদ্দিনের ঘুষ-দুর্নীতি : অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর এসএমপির কেন্দ্রীয় রিজার্ভ অফিসার-১ (আরও-১) হিসেবে যোগদান করেন কুমিল্লার বাসিন্দা এসআই (নি.) মো. খায়রুদ্দিন। এর আগে তিনি এসএমপির সিটিএসবির ওসি-ওয়াচের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে পাসপোর্টের ভিআর ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে তাকে সিটিএসবি থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে কেন্দ্রীয় রিজার্ভের আরও-১-এর দায়িত্ব পেয়ে আবারও শুরু করেন অনিয়ম। তার এমন কর্মকাণ্ডে এসএমপির অফিসার ও ফোর্সরা অতিষ্ঠ। তিনি টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না। বিশেষ করে তার বদলি বাণিজ্য এসএমপির প্রায় সবারই জানা। সদর ডিভিশন ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার কেন্দ্রীয় বিজার্ভের অধীন থাকায় পুলিশ লাইন্সের অসংখ্য ফোর্সের এলএপি, আরআরএল, মাতৃত্বকালীন ও বহিঃ বাংলাদেশ ছুটির ক্ষেত্রে দুই শ থেকে পাঁচ শ টাকার বিনিময়ে ছুটির আদেশ করে দেন। এসএমপি থেকে বহিঃজেলা/ইউনিটে বদলির জন্য করা আবেদন অগ্রগামী করার জন্য গুনতে হয় হাজার দুয়েক টাকা। এসএমপির উত্তর ও দক্ষিণ জোনের সব থানার এবং বিভিন্ন অফিসের কম্পিউটার অপারেটররাও মাসের ১-৫ তারিখের মধ্যে খায়রুদ্দিনকে ১-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসোহারা দিতে বাধ্য হন। যদি কোনো থানা বা ফাঁড়ির মুনশি/ক্যাশিয়ার মাসোহারার টাকা না দেন, তাহলে তাকে অন্য জোনে বদলি করা হয়। পরে আবার বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে পুনরায় আগের জায়গায় নিয়ে আসেন খায়রুদ্দিন। তিনি এসএমপি কমিশনারের খাস লোক হিসেবে রিজার্ভ অফিসে পরিচিত। তিনি যা বলেন, তাই-ই নাকি পুলিশ কমিশনার শোনেন। তাছাড়া প্রায় সব ফাঁড়ির ইনচার্জরাও মাসের প্রথম সপ্তাহে ৪-৫ হাজার টাকা মাসোহারা দেন। স্বেচ্ছায় মোটর ড্রাইভিং ট্রেনিং, ট্রাফিক ট্রেনিং, ভেহিকল মেকানিক ট্রেনিং ও কম্পিউটারের বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য অনেকেই আবেদন করেন। ১০-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে খায়রুদ্দিন এসব ক্ষেত্রে প্রার্থী মনোনীত করেন। মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে এসএমপি-৩৮৭৬/১(১৩)/আরও(কেন্দ্রীয়) স্মারকে ১৭ আগস্ট একসঙ্গে ৩৯ জন পুলিশ সদস্যকে তাদের পছন্দমতো জায়গায় বদলি করিয়ে দেন। বিনিময়ে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে ১০-২০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন। একদিনে একসঙ্গে ৩৯ জন পুলিশ সদস্যের বদলির আদেশে এসএমপির অফিসার ও ফোর্সদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খায়রুদ্দিন বলেন, কোনো অফিসার বা ফোর্সের কাছ থেকে কখনও একটি টাকাও গ্রহণ করিনি। কেউ দিতে চাইলেও নিই না। ফোর্সদের জিজ্ঞেস করুন। যদি বলতে পারে আমাকে টাকা দিয়েছে, তাহলে কান কেটে ফেলব।
এ ব্যাপারে এসএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের যুগান্তরকে বলেন, রুটিন অনুযায়ী ডিউটি বণ্টন করা হয়। বাকি অভিযোগের ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কোনো ফোর্সের অভিযোগ তদন্ত হয়ে থাকলে রিপোর্ট অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হবে, সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে। আপনারাও জানবেন।
সূত্র: যুগান্তর