১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই’র পীর সৈয়দ এসহাক (রহ.) ও সৈয়দ ফজলুল করীম (রহ.) এর কি ভূমিকা ছিল। এই বিষয়ে একবার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এক কলাম লেখায় বলেছিলেন চরমোনাই পাকিস্তানের সহচর ছিলেন। কিন্তু এ ধরণের ভ্রান্ত মন্তব্যের কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। বরং চরমোনাইর পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই যে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন তার অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। পরে বঙ্গবীর চুপষে গেছেন, না জেনে কোন মন্তব্য করলে যা হবার তাই হয়েছে। এখন আবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ নতুন করে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন মাওলানা সৈয়দ মো. ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই (রহ). ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করে চরমোনাই মাদরাসায় আশ্রয় নেয়া মা বোনদের গনিমতের মাল বলে ফতোয়া দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক দেশে যেকোন ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে তা হতে হবে সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু মাহবুবুল আলম হানিফ চরমোনাই পীরকে নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। মাহবুবুল আলম হানিফ হোক বা দেশের যেকোন ব্যক্তিই হোক কারো বিরুদ্ধে আলোচনার পূর্বে তার সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে বক্তব্য দেয়া। না হয় হিতে বিপরীত হতে পারে। পীর সাহেব চরমোনাইর নামে পাকিস্তানীদের সম্পর্ক ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্পর্ক ছিল তা চরমোনাই ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলর বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করে জেনে নেয়া যেত। যেহেতু চরমোনাই ইউনিয়নে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনও জীবিত আছেন। তারাই তাদের এলাকার খবর ভাল জানেন। তারা স্বচক্ষে দেখা বিষয় ভালো বলতে পারবেন। তাদের সাথে আলোচনা না করে কেহ যদি অন্য জায়গায় বসে সে যদি সেক্টর কমান্ডারও হয় এবং বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা না করে চরমোনাইকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন তাহা ভূল হতে পারে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র অবস্থায় চরমোনাই ইউনিয়ন সহ বরিশালের যে সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং চরমোনাই ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার ও সদস্যদের এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ১৯৭১ সালে চরমোনাই পীরের ভূমিকা ও মাদ্রাসা সম্পর্কে স্বচক্ষে দেখা প্রতিবেদন সাক্ষাতকারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হলো। এবং সাক্ষাতকারের ভিডিও দেশের সকল জাতীয় স্থানীয় পত্রিকায়, অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রেরণ করা হয়েছে।
১। বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে চরমোনাই ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মির্জা আবু আল হোসাইন সরদার বলেন, ১৯৭১ সালে অগ্নিঝড়া দিনগুলোতে এই চরমোনাইর দরবার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে পাকিস্তান আমলে চরমোনাই মাদ্রাসার একটি মঞ্জুরীর বিষয় ছিল, চরমোনাই পীর সৈয়দ এসহাক ও পাকিস্তান সরকারের বশ্যতা স্বীকার না করার কারণে মাদ্রাসার মঞ্জুরী হয় নাই। তখন পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন আসছিল কিন্তু কোন কিছুর বিনিময় না থাকার কারনে টাইটেল মঞ্জুরী হয় নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চরমোনাইসহ বিভিন্ন এলাকায় লুন্ঠন ও নির্যাতন শুরু হলে সেই কঠিন মুহুর্তে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দু লোক সহ সবার আশ্রয়স্থল ছিল চরমোনাই মাদ্রাসা। তিনি আরও বলেন, আমার বয়স ২০/২২ বছর হবে আমার সবকিছু মনে আছে অনেক হিন্দু হুজুরের কাছে মুসলমান হতে চাইলে সৈয়দ এসহাক (রহ.) বললেন, এই দুর্যোগ মুহুর্তে আপনার ধর্মান্তরিত হবেন না দেশ স্বাধীন হোক তারপর আপনারা বুঝে শুনে যা করেন করবেন। মেয়ে লোকদের ব্যাপারে এখন যা শুনছি কিভাবে যে এর জবাব দেব তা বুঝে উঠতে পারছিনা হিন্দু মহিলারা তার মায়ের কোলের চেয়েও মাদ্রাসায় নিরাপদ ছিল পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয়ার কথা যদি কেহ বলে সে মানুষ নয়, অমানুষ মিথ্যাবাদী।
২। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু জীবন চন্দ্র মন্ডল বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৭ বছর। আমি ভাল মন্দ সব বুঝি আমার কাছে কিছু হিন্দু লোক নিরাপত্তার জন্য আসলো, তারা হলো নীল কান্ত ঘোষ, মাখম লাশ ঘোষ, মতি ঘোষ, অরিনান্দ তালুকদার, গনেষ চন্দ্র, মাখন লাল হালদার। তাদেরকে মাদ্রাসায় হুজুরের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। সৈয়দ এসহাক (রহ.) বললেন, দেশে এখন অরাজকতা চলছে। এই মুহুর্তে ধর্মান্তর হওয়া ঠিক হবে না। আপনারা এখানে শান্তিতে খাওয়া দাওয়া সেরে থাকুন এবং মহিলাদের নিয়ে যে মিথ্যা অপপ্রচার ও বানোয়াট কথাবার্তা বর্তমানে শুনতেছি, আমি একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ আমি স্বচক্ষে যাহা দেখেছি তাতে কোন মহিলা নির্যাতিতা দুরের কথা একটু কষ্টও পাইনি। এবং কোন মুক্তিযোদ্ধের কাছ থেকে কোনদিন কখনও খারাপ কিছু শুনতেও পাইনি। এতে যদি আমাকে কোথাও গিয়ে প্রতিবাদ করতে হয়, তাহলে প্রমাণ সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি হাজির হবো।
৩। বীর মুক্তিযোদ্ধঅ শহীদ উদ্দিন গাজী বলেন, যদি কেহ বলেন- মুক্তিযোদ্ধকালীন চরমোনাই মাদ্রাসায় অবৈধ কোন কিছু ঘটছে তার উপর আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম সে যেন আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে তবে তা সত্য ও যুক্তিসংগত হতে হবে। তিনি বলেন, আমার গ্রাম রাজারচর, পোঃ সাহেবের হাট, জেলা- বরিশাল, আমি বুখাইনগর রাজারচর, চরকারন্দি, চরামদি, মিহিন্দিগঞ্জ, ভাসানচর এলাকায় আমি মুক্তিযুদ্ধাদের নিয়ে কাজ করি। আমি সামরিক বাহিনী থেকে বের হয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমরা এক জায়গায় ১৯ জন আর্মির লোক ছিলাম। আমরা ৪দিন যাবত উপবাস ছিলাম। তখন চরমোনাই মাদ্রাসায় এসে সৈয়দ এসহাক (রহ.) এর সাথে দেখা করলাম, তিনি আমাদের খাবারের ব্যবস্থা কররেন তখন আমাদের এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি ক্যাম্পি ছল মাদ্রাসার মধ্যে। সেখানেই সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো এবং নদীতে যখন পাকিস্তানী ছোট ছোট গানভোটের আওয়াজ পাওয়া যেত, তখন সৈয়দ এসহাক (রহ.) বলতেন- সবকিছু গুছগাছ করে কাজ বন্ধ রেখে নিরব হয়ে যাও। তারা চলে গেলে, আবার আমরা স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। আমাদের ও হিন্দুদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল চরমোনাই মাদ্রাসা।
৪। প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ হাওলাদার তিনি বলেন, আমার বয়স ৮২ বছর। আমি যাহা চোখে দেখেছি এবং যাহা জানি তাহাই আজ আপনাদের সামনে বলবো। আমার চেয়ে বেশী বয়সী মুরব্বি মুক্তিযোদ্ধা এখানে আর কেহ নাই। আমি আর্মির চাকুরী থেকে চলে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চরমোনাই মাদ্রাসায় সৈয়দ এসহাক (রহ.) এর কাছে এসে বললাম হুজুর আপনি আমাদের জন্য দোয়া করুন হুজুর দোয়া করলেন এবং বললে দেশ অবশ্যই স্বাধীন হবে। তবে একটু দেরী হবে। তখন আমরা খাবারের জন্য কিছু সাহায্য চাইলাম হুজুর বললেন তোমরা কতজন লোক, আমি বললাম আমরা ১২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা চরমোনাই ইউনিয়নের মোহনগাজীর বাড়িতে আছি। হুজুর বললেন তোমরা যাও, আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। এর কিছুক্ষণ পর ২টিন সরিষার তেল, চাল, ডাল পাঠিয়ে দিলেন। এই এসহাক রহ. এর মতো মানুষ আমাদের এতো উপকার করার পর তার বিরুদ্ধে যদি কেহ কথা বলে তাহলে তাকে মানুষ বলা যায় না। চরমোনাইর বিরুদ্ধে যদি কেউ কিছু কথা বলতে চায়- সে যেন চরমোনাই তথা বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করে ১৯৭১ সালে চরমোনাইর ভূমিকা কি ছিল তা জেনে শুনে মন্তব্য করে।
৫। বঙ্কিম চন্দ্র হাওলাদার তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী বরিশালে প্রবেশ করার পর চরমোনাই সহ বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন শুরু হলে তখন আমরা হিন্দুরা চরমোনাই মাদ্রাসায় গিয়ে নিরাপত্তার জন্য সৈয়দ এসহাক (রহ.) এর কাছে মুসলমান হতে চাইলাম। হুজুর বললেন, আপনারা এখন মুসলমান হবেন না। এ দেশ স্বাধীন হবে ইনশাআল্লাহ। এর পরে যা খুমি তা করবেন। সৈয়দ এসহাক (রহ.) আমাদের হিন্দুদের জন্য লঙ্গরখানা খুলে দিলেন এবং হিন্দুরা যে ধরণের স্বাভাবিক খাবার খায় সে ব্যবস্থা করলেন। আমাদের হিন্দু মহিলাদের ও পুরুষদের জন্য আলাদা আশ্রয়স্থল করে দিলেন। (এ কথা বলে তিনি কেঁদে ফেললেন)। সৈয়দ এসহাক (রহ.) এর মুখ থেকে বারবার শুনেছি আপনার ধৈর্য্য ধরুন, এদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আমরা হিন্দু পুরুষ মহিলারা বাড়িঘর ত্যাগ করে মাদ্রাসায় থাকি, খাই। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি।
৬। বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকিব আলী খান বলেন, আমার মনে প্রাণে খুব আঘাত লেগেছে যে, আমাদের মরহুম পীর সৈয়দ এসহাক (রহ.) এর নামে মিথ্যা কথা বলা সে মানুষ না, সে অমানুষ। চরমোনাই মাদ্রাসা ছিল পুরো বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি। তারা যদি বিপক্ষে থাকতো তাহলে আমিও বাচতাম না। পাকিস্তানীদের সাথে হুজুরের সম্পর্ক ছিল; তার নামে এরকম মিথ্যা কথা বলা ঠিক নয়। না জেনে শুনে একজন সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া ঠিক নয়। আমরা স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা কোনভাবেই হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ মেনে নিতে পারিনা।
চরমোনাই’র পীর সৈয়দ ফজলুল করীম (রহ.) বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীতার জবাবে বায়তুল মোকাররামের উত্তর গেটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে এক সমাবেশে পরিস্কারভাবে তিনি ঘোষনা করেছিলেন যে, আমি স্বাধীনতার বিপক্ষে নই, স্বাধীনতার পক্ষেই ছিলাম। চরমোনাই মাদ্রাসা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল। তারপরও কেহ যদি প্রমাণ করতে পারে, আমি স্বাধীনতা বিরোধী ছিলাম। তাহলে ফাসির কাস্টে ঝুলতে রাজি আছি। এই লেখক সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। এবং তিনি নিজের কানে এ ঘোষনা শুনেছেন। যা তৎকালীন সময় জাতীয় গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
লেখক: ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
রাজনীতিবিদ ও কলামিষ্ট
Editor: Shahin Ahmed & Sadrul Islam Lukman
Office: Hoque Super Market, 3rd Floor, Zindabazar, sylhet.
Email: ekusheynet.syl@gmail.com
Contact: 01739447302