প্রতিদিন ডেস্ক :: শুরু ২০২০ সালের মার্চে। এরপর থেকে চলছেই। ২০২১ সালেরও প্রায় অর্ধেক চলে গেছে। তবু পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে ফেলা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি বিদায় নেয়ার লক্ষণ নেই। এর ফলে প্রায় দুটো বছরই কেটে যাচ্ছে এই ভাইরাসের আতঙ্কে।
সারাবিশ্বের মতো স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে বাংলাদেশেও। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত। সিলেটসহ সারাদেশে দলটির ছয় শতাধিক নেতা মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে।
মহামারির মধ্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, কোথাও সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচি নেই। এতে ঝিমিয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। তৈরি হয়েছে অভ্যন্তরীণ দূরত্ব। এই দূরত্ব কোথাও কোথাও দ্বন্দ্ব-সংঘাত, এমনকি খুনের ঘটনায়ও গড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে এ দুই বছর শাখা সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। সভা-সমাবেশ-সেমিনার এমনকি নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের যোগাযোগ স্থাপনও করা যায়নি। সব কিছুতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দল।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, করোনাকাল কেটে গেলেই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন উদ্যমে কাজ করবেন তারা।
দলের দফতর সূত্র জানিয়েছে,করোনাকালে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাত নেতাসহ ছয় শতাধিক নেতা মারা গেছেন। এদের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি মকবুল হোসেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু, মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুন, কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী, ঢাকার এমপি আসলামুল হক প্রমুখ ছিলেন।
তবে করোনাকালেও ঘটেছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মৃত্যুর ঘটনা। বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষে দলটির ডজনেরও বেশি নেতাকর্মীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আমিনুল ইসলাম নিক্সন (৪৫), গাইবন্ধার সাঘাটায় বজলুর রশিদ বুলু (৫৮), বান্দরবান সদরে চাইন ছাহ্লা (৩৮), চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আব্দুল হক, কক্সবাজারের মহেশখালীতে আবু বক্কর (৩০), ঝিনাইদহের শৈলকুপায় লিয়াকত হোসেন বল্টু (৫০)-সহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বলি হয়েছেন।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে সব ধরনের কর্মকাণ্ড স্থবির, মানুষের জীবনই বিপন্ন। অফিস আদালতসহ সব কিছুই বন্ধ। এমনকি পৃথিবীতে ৩৭ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ১৭ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত। এমন একটা দুর্যোগের সময় আওয়ামী লীগের প্রধান দায়িত্ব ছিল সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো; করোনায় যেন আক্রান্ত না হয় সেজন্য মানুষকে সচেতন করা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী পৌঁছে দেয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া। পাশাপাশি কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোসহ যেখানে যেটা প্রয়োজন, এই দুর্যোগে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তা করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে জনগণের পাশে থেকে কাজ করবে। আমি মনে করি, এটা সফলভাবে করা গেছে। আমরা প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ পরিবারকে দলীয়ভাবে ত্রাণ দিতে পেরেছি। পাশাপাশি সব ধরনের সহায়তা দিয়েছি।’
হানিফ দাবি করেন, ‘এর মধ্যেও সাংগঠনিক তৎপরতা সীমিত আকারে ছিল। অনেক ইউনিয়ন ও উপজেলার কাউন্সিল হয়েছে। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগেরও কাউন্সিল হয়েছে। আমাদের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগেরও সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল। তারাও জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এই দুর্যোগ মোকাবিলায়। পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজও করেছে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন ও সাংগঠনিক কাজ, দুটোই সমান্তরালভাবে করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন করোনার প্রকোপ কমলে আগামী কাউন্সিলকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজানোর যে প্রক্রিয়া, সেটা নবোদ্যমে শুরু করবো। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কাউন্সিল শেষ করে জাতীয় কাউন্সিল করবো।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এ বিষয়ে বলেন, ‘করোনায় প্রকাশ্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করা সম্ভব হয়নি। তবে রাজনীতির মূলমন্ত্র মানবসেবা। করোনাকালে মানবসেবার উত্তম কর্মে অংশগ্রহণ করার অপার সুযোগ হয়েছে আমাদের। ফলে রাজনীতির শুদ্ধতম কাজে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমরা গর্বিত। এটি একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য পরম সৌভাগ্য।’
আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘করোনাকালে অবশ্যই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও সাংগঠনিক কর্মসূচি সঠিকভাবে করতে পারেনি। আমাদের নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের যোগাযোগের বাধা হচ্ছে করোনা। আমরা যে মাত্রায় করতে চেয়েছি, পারিনি। আমরাও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না, কথা বলতে পারি না। আমরাও তাদের অভাববোধ করি। আওয়ামী লীগ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবশ্যই হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন করোনা স্বাভাবিক হতে যাচ্ছিল, সে সময় কিন্তু আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জেলায় সম্মেলন শুরু করেছিল। এখন তো সরকারিভাবে বিধিনিষেধ দেয়া, এখন এই করোনায় যদি আমরা এক জায়গায় জমায়েত হই, সেক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধ তো দূরের কথা, বাড়ার ঝুঁকি থাকে। একদিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, আরেকদিকে নিজেদের সতর্কতা, দুটোর কারণেই সাংগঠনিক কাজগুলো ঠিক মতো করা যায়নি। স্বাভাবিক সময় এলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হবে।’
করোনাকালে যাদের হারাল আওয়ামী লীগ
করোনা পরিস্থিতিতে ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু করোনায় মারা গেছেন। সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরীও মারা গেছেন এ বছরই। ঢাকার এমপি আসলামুল হক করোনাকালেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার করগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ এমরান আলী, বগুড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ফাঁপোর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান-প্রভাষক আবদুর রাজ্জাক, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং সাবেক কাউন্সিলর আলমগীর হোসেন, যশোর চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান নিপু এবং যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জর্জিয়া আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রমেশ চন্দ্র সাহা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এ বছর।
২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ ও নানা অসুখে কেন্দ্রীয় ছয় নেতাসহ ছয় শতাধিক নেতা হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি মকবুল হোসেন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেটে সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এবং সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
একইসঙ্গে ভাষাসৈনিক ও সাবেক এমএলএ আহমেদ আলী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, ঢাকা-৫ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা, নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ও নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ইসরাফিল আলম, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, মানিকগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি শামসুদ্দিন আহমেদ, সংরক্ষিত আসনের এমপি ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী, বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট-৪ আসনের এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেন, মৌলভীবাজার-১ আসনের সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি মমতাজ বেগম, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামান ও বগুড়া-১ আসনের এমপি আবদুল মান্নান ২০২০ সালেই মারা গেছেন।
এছাড়া ২০২০ সালে মারা গেছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আক্রামুজ্জামান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ রওশন আলী, টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বকুল, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জি এম দেলোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. শাহ আলম, খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা অহিদুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাহীন চৌধুরী, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগরের অন্তর্গত ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসউদ্দিন, পাবনা জেলার আতাইকুলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইসমাইল হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগরের অন্তর্গত চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রহমান, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকুল সিদ্দিকী।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক আব্দুল মাহি লাল্টু, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা শহিদুজ্জামান সোনা মিয়া, টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম, বগুড়া জেলার ধুনট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রশিদ হেলাল, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মাহমুদুর রহমান, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও মতলব দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরুল হক, যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ আমির হোসেনও এই করোনাকালে প্রয়াত হয়েছেন।