মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী::
অটোপাস আর প্রমোশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সরকার দ্বি-মুখী আচরণ করছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। দেশে অফিস-আদালত, ‘গার্মেন্টস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শপিংমল সবই খোলা আছে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেনো? প্রকৃত অর্থে সরকারের মধ্যে থাকা বৈষম্যের নীতিই এর মূল কারণ। সরকারে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশের সন্তান বিদেশে থাকে। যাদের পরিবার-পরিজনের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু সমস্যা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তাদের। এদের প্রতি তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই।
সা¤প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতি ও ঘরে ঘরে অনলাইন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা এসেছে। এখন যেন সমস্ত পৃথিবী ঝুঁকে পড়েছে ইন্টারনেটে। এর প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি কোমলমতি শিশুরাও। এই ইন্টারনেট বধ করেছে তাদের শৈশবকেও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। যেটি আমাদের দেশের শিশুদের মধ্যেও সা¤প্রতিক সময় অতিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন কি কোচিংও বন্ধ থাকায় শিশুকিশোররা ইউটিউব, ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারের মতো অ্যাপসগুলো তাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। আর এগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে তারা বাসার কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন ব্রাউজ করছে। থাকছেনা কোন ভয়ভীতি ও শ্রদ্ধা বা পরিমিতিবোধ। বাড়ীর আঙিনা,ঘরের ছাদ এমন কি বনে জঙ্গলে বসে মোবাইলে গ্যাম,জুয়ায় লিপ্ত কিশোর-যুব সমাজ।
পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ছাড়া বন্দী বন্দি জীবনযাপন করছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে, বাল্য বিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেকে মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে, মাদকাসক্ত ও কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। করোনাকালে যৌন সহিংসতা, নিপীড়ন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেকোনো সংকটজনক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় নারী ও শিশুরা। গেল বছর করোনার শুরুরপর থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই নারী নিপীড়ন ও সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি তারই প্রমাণ। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি কিছু সংস্থা কাজ করলেও সরকারের তরফে তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাঁরা বলছেন, সরকারের এমন ‘নির্বিকার অবস্থান’ সহিংসতা আরো বাড়িয়ে দেবে এবং অপরাধীরাও পার পেয়ে যাবে। বিচারহীনতা, রাজনৈতিক প্রশয়, ধর্ষণের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম বে¬ইমিং (ভুক্তভোগীকেই উল্টো দোষারোপ করা) যৌন সহিংসতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে তাঁদের অভিমত। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য গঠিত ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত যৌন হয়রানির শিকার আট হাজার ৪১৫ নারী ও শিশু সেবা নিয়েছে। গত বছর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ১৯ নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।করোনাকালে নারীরা বীভৎসভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই সংকটকালে যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতা বন্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, ‘লকডাউনে নারী ও পুরুষ একই ছাদের নিচে থাকতে হয়েছে। এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্দশায় যৌতুকের দাবিতে কিংবা কলহের জেরে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
করোনাকালে দেশে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তড়াল হারে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। দেশে ফেসবুক, ইউটিউব, লাইকি, টিকটক, বিগো লাইভের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ শুধুই বেড়ে চলেছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনাও বেড়েছে। নতুন যুক্ত হয়েছে এটিএম হ্যাকিং। এ ছাড়া ই-কমার্সে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনাও বেড়ে চলেছে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশনের ‘সাইবার ক্রাইম ট্রেন্ড ইন বাংলাদেশ-২০২০’ শীর্ষক বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশে¬ষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, ২৮.৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ১৫.৩৫ শতাংশ। আবার অপপ্রচারের ঘটনা ২২.৩৩ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬.৩১ শতাংশ।
যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করে হয়রানি আগের ৬.০৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭.৬৯ শতাংশ। তবে ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানি কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৮৫ শতাংশ
মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, দেশে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীজনসহ সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তৃণমূল পর্যায় থেকে অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশের সক্ষমতা বেড়েছে। তবে এই অপরাধের বিস্তার এখন গ্রামে পৌঁছে গেছে। তাই প্রতিটি থানায় অপরাধ শনাক্তে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু। প্রান্তিক পর্যায়ে শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি কাটাতে ভালোর জাগরণ গড়ে তোলার আহŸান জানান শারমিন নাহার লিনা। গবেষণায় সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাইবার স্কোয়াড গঠন, ই-কমার্স নীতিমালা ও রাজনৈতিক জনশক্তিকে সচেতনতামূলক কাজে নিয়োজিত করাসহ ৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. নাছিম আখতার ‘প্রযুক্তির অপব্যবহারে সমাজ বিপন্ন’ র্শীষক লেখায় উলে¬খ করেন,”করোনা মহামারিতে মানবজাতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকালে ঘরে বসে মানুষ তার অবসর সময়ের বেশির ভাগটাই ব্যয় করছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে। যার ফলে দেখা দিচ্ছে নানা মানসিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা অনেক সময় মানসিক রোগে পরিণত হচ্ছে। আমরা জানি, মানুষের আনন্দ বা সুখের হরমোনগুলোর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে দরকার খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও কায়িক পরিশ্রম। কিন্তু বর্তমান সমাজের জীবনব্যবস্থা হয়ে পড়ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ খেলাধুলা, শরীরচর্চা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মোবাইল বা কম্পিউটারে সময় কাটাচ্ছে। যার ফলে শরীরে হরমোনের অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়ছে বিষাদগ্রস্ত, অলস ও কর্মবিমুখ। রাত জেগে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর ফলে পরিমিত ঘুম হয় না। এতে শরীরে বাড়ছে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা, যা মানুষকে ধৈর্যহীন, খিটখিটে মেজাজের জীবনযাপনের পথে পরিচালিত করছে। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীরা দূরশিক্ষণ সুবিধা নিতে দিনের বেশির ভাগ সময়ই কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার দোহাই দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন ইন্টারনেট গেম এবং হাস্যরসাত্মক ভিডিও বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। নানা চেষ্টা করেও অভিভাবকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। গবেষণা বলছে, কভিড-পরবর্তী সময়ে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহার করছে, ঝুঁকছে পর্নোগ্রাফির সাইটেও। মনোবিজ্ঞানী ও সাইকিয়াটিস্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকার কারণে এবং স্মার্টফোনের অপব্যবহারের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসছে। এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের স্বাভাবিক মানসিক গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাত জেগে অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। অনলাইন গেম শিশু-কিশোরদের শুধু মানসিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। খেলার নেশায় কোমলমতি তরুণরা মা-বাবার পকেট পর্যন্ত কাটছে।”
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা জ্ঞান চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে আগামী প্রজন্ম। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী করোনাকালে গত ১৫ মাসে ১৫১ জন শিক্ষার্থী মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। তাই, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাত্র ও শিক্ষকদের করোনার টিকা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে হবে।
তথ্য-প্রযুক্তি ছাড়া বর্তমান পৃথিবী প্রায় স্থবির। তাই মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে কোনো সমাধান আসবে না। ব্যবহারকারীদের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক দিক বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রলোভন ও প্রতারণার ফাঁদের কথা এবং এর ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে টেলিভিশন, রেডিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা জরুরি। সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে-মেয়েরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করছে ভার্চুয়ালজগতে সে সম্পর্কে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মা-বাবাকে সন্তানের সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যাতে তারা বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আশ্রয় না খোঁজে।
দীর্ঘ দিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময়ে বাহিরে ঘুরাঘুরি করছে, টিভি দেখে ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সময় ব্যয় করছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খারাপ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে দেওয়া প্রয়োজন। করোনা মহামারীতে জীবন-জীবিকা এলোমেলা হয়ে গেছে। কর্মহারা হয়ে পড়ছে মানুষ, এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা। শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শিশু-কিশোর-তরুণদের আসক্তি বাড়ছে ইউটিউব, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সার্বিক এই পরিস্থিতি তাদের মনোজগতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এর প্রমাণ মিলেছে কিছু গবেষণায়। গত বছরের ১৯-২৮ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৫০৯ জন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদা সালমার নেতৃত্ব্ে পাঁচ সদস্যের গবেষণা দলে ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ খায়রুল আলম, ফেরদৌস বিন আলী, রাজন বণিক ও সাবিনা ইয়াসমিন। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি জার্মান পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় উলে¬খ করা হয়, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্তি¡ক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। গবেষণার ফলে দেখা যায়, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ হালকা, ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ মধ্যম, ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ মাঝারিভাবে মারাত্মক এবং ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। পরিবারের সদস্যদের করোনা আক্রান্ত হওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অধিক ব্যবহার এবং ধূমপানের অভ্যাস শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতির কারণ।
এ ছাড়া মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, রাজু মাহমুদ, নাজমুল হোসাইন, শরিফ হোসাইন, রাজন বণিক ও সাবিনা ইয়াসমিনকে সঙ্গে নিয়ে করোনাকালে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নাহিদা সালমার আরেকটি গবেষণা প্রকাশ পায়। গত বছরের ২৫ এপ্রিল-৯ মে পর্যন্ত ১৫ বছরের কম বয়সী ৩৮৪ জনের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ শিশু অতি অল্প মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে, ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ অল্পভাবে, ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিমিত মাঝারিভাবে, ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু মারাত্মকভাবে অস্থিরতায় ভুগছে। ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি জানতে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এ সময় মানুষের উদ্বেগ ও বিষণœতার হার কয়েক গুণ বেড়েছে। আয় সংকুচিত হয়ে মানুষের হতাশা বাড়ছে, মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট দেখা দিচ্ছে। আমরা হয়তো একদিন করোনাভাইরাসের থাবা থেকে মুক্ত হব। কিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। মহামারী করোনার প্রতিঘাতে সব বয়সী মানুষকেই মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের মধ্যে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ জাতীয় জরিপে দেখা যায় দেশে প্রায় ১ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত ১৪ বছরে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগী বেড়েছে ৫৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৮ জন। করোনাকালে এ পরিস্থিতি আরও ব্যাপক রূপ নিয়েছে। জীবিকার সংকট, ভয়, আতঙ্ক, চোখের সামনে বীভৎস মৃত্যু দেখা, নৃশংসতা আমাদের মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশে এলএসডির মতো মাদক সেবন চলছে, মাদকাসক্ত হচ্ছে মানুষ, আত্মহত্যা বাড়ছে। সন্তানকে হত্যা করছে, স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে, মানুষকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করছে। এ রকম ঘটনা আগেও ঘটত কিন্তু ইদানীং আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী ‘গৃহবন্দি’ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সংক্রমণ অনেকটা কমে আসায় এবং করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় অবশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতির কথা শুনা গেলেও সহসাই চালু হচ্ছেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাহলে কি বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় তবে কি আজীবন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে?
আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার ঝরে পড়ার হার নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা করোনাকালে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়েছে, তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না। আবার অনেকে স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাসে অনুপস্থিতির হার বাড়বে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এখনো এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। এমনকি শিক্ষকরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছেন না। এটি নিঃসন্দেহে শিক্ষার একটি অস্বস্তিদায়ক চিত্র। ২০১৯ সালের প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এ হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে ঝরে পড়ার হার অনেক বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওড় অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়ের হারও।
দেশে এখন ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরও ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে। স¤প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিুআয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিুআয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। স¤প্রতি প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্র্বতীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন, অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়ে যাবে। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় আছে কিন্ডারগার্টেনগুলো। সারা দেশের ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেনে প্রায় ৮০ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। সরকারি প্রাথমিকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তার প্রায় অর্ধেকসংখ্যক পড়াশোনা করে কিন্ডারগার্টেনে। কাজেই এ ব্যাপারে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। দ্রুত স্কুলগুলো খুলে না দিলে কিন্ডারগার্টেনেরও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে।
ডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বতীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়. দ্রুতক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একই মত দিয়েছেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তথা মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বেঁধে দেওয়া শর্তাবলি পালন করে দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘স্কুল রি-ওপেনিং প¬্যান’ তৈরি করেছে। এতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, স্কুল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। গত ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর গত ১৭ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত বছর শর্তসাপেক্ষেকেওমি মাদরাসা সমূহ চালু রাখার অনুমতি দিলেও চলতি বছর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ রয়েছে কওমি মাদরাসা।
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে । গত ১২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ায় এবং দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে আংশিকভাবে কঠোর লকডাউন কার্যকর থাকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় এবং কোভিড -১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এবতেদায়ি ও কওমি মাদ্রাসাসমূহের চলমান ছুটি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে । গত ২৪ মে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ১৩ জুন দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকার অজুহাতে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হলো। এর ফলে টানা প্রায় ১৫ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সচেতন মহলের প্রশ্ন হলো-বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় তবে কি আজীবন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে?
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক-জাতীয় লেখক পরিষদ। ০১৭১৬৪৬৮৮০০।
Editor: Shahin Ahmed & Sadrul Islam Lukman
Office: Hoque Super Market, 3rd Floor, Zindabazar, sylhet.
Email: ekusheynet.syl@gmail.com
Contact: 01739447302