স্টাফ রিপোর্ট::
রোমানিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নাম করে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সিলেট নগরর জিন্দাবাজারস্থ হক সুপার মার্কেটের আমিন রহমান ট্রাভেলস এর স্বত্তাধিকারী আমিন রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) দুপুর ২টার দিকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন এসএমপি’র কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ।
এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমিন রহমান ট্রাভেলসের মালিক আমিনুর রহমান, তার ভাই সিদ্দিকুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে আসামী করে এসএমপির কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী ফখরুল ইসলাম। মামলা নং-৭০ (২৭/০২/২০২২)। তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নিজগাওয়ে। তারা সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহরের জি ব্লকের ৪ নং রোডের ৯৬ নং বাসার বাসিন্দা এবং তোফাজ্জল আলীর পুত্র।
মামলা ১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের দাবি তুলা হয়েছে। বাদী ছাড়াও ১৮ প্রতারিত তরুণ-তরুণী মামলার স্বাক্ষী হয়েছেন। তারা নগদ ১ কোটি ১৭ লাখ ৬৫ হাজার প্রদানের ফিরিস্তি এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে পলাতক হয় প্রতারক আমিন।
জানা যায়, প্রতারক আমিন রহমান কানাডা, রোমানিয়া ও পোল্যান্ড পাঠানোর নামে শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে ১৫ কোটি হাতিয়ে নিয়েছে। টাকা নিয়ে ভুক্তভোগীদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন জাল ভিসা ও টিকিট।
ভুয়া কাগজপত্রের কারণে বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে হয়েছে অনেককে। তার প্রতারণার শিকার অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি। প্রত্যেকের সঙ্গে জাল ভিসা ও টিকিট দিয়ে প্রতারণা করেছেন তিনি। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা সর্বস্ব হারিয়ে এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, কানাডা, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া পাঠানোর নামে প্রায় দুইশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেন আমিন রহমান ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আমিনুর রহমান। কানাডা পাঠানোর নামে ১৭ লাখ টাকা চুক্তি করে ২০ থেকে ২৫ জনের কাছ থেকে দুই দফায় নিয়েছেন ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে পাসপোর্ট নেওয়ার সময় দুই লাখ টাকা পরে টিকিট দেওয়ার সময় নেন বাকি ১৫ লাখ টাকা। একইভাবে ১২ লাখ টাকায় পোল্যান্ড পাঠানোর চুক্তি করে ২৫ থেকে ৩০ জনের কাছ থেকে দুই দফায় নেন ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া রোমানিয়া পাঠানোর কথা বলে ৭ লাখ টাকা চুক্তি করে দেড়শতাধিক লোকের কাছ থেকে নিয়েছেন ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে রোমানিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে ১১ জনের ফ্লাইট ছিল। ঢাকার এজেন্সি যাত্রীদের হাতে ভিসা ও টিকিট তুলে দেওয়ার শর্তে যাত্রীদের সিলেট থেকে ঢাকা পাঠান আমিন। বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিদেশযাত্রীরা। এর ভেতরে ওই ১১ জন পুরো টাকা জমা দেন। পরে আমিন বলেন ঢাকার এজেন্সি ভিসা ও করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট এক সঙ্গে তাদের হাতে দেবে। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিসা ও পাসপোর্ট না পাওয়ায় সিলেটে অবস্থানরত আমিনকে কল দেন যাত্রীরা। কিন্তু তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের। ভিসা ও বিমানের টিকিট না পেয়ে ঢাকা থেকে ফিরে এসেছেন অনেকে। কেউ আবার লোক লজ্জার ভয়ে সেখানেই থেকে গেছেন।
একইভাবে শনিবার রোমানিয়া যাওয়ার জন্য আরো ৯ জনের ফ্লাইট ছিল। তাদের হাতে জাল ভিসা ও টিকিট ধরিয়ে দিয়ে পুরো টাকা আগেই বুঝে নিয়েছেন আমিন। প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, রোমানিয়া যাওয়ার জন্য আগামীকাল রোববার ১১ জন, পরদিন সোমবার আরো ১১ জন ও আগামী মঙ্গলবার চারজনের ফ্লাইটের কথা রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেও জাল ভিসা ও টিকিট তুলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা জানান, খবর জানাজানি হলে শুক্রবার আমিনের বাসায় গিয়ে বাসা তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। মুঠোফোনেও যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। শনিবার অফিসে এসেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসময় তার অফিসের এক কর্মী জানান তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। হোয়াটসঅ্যাপে একটি নম্বরে যোগাযোগ করে বলেছেন ফ্লাইট না হলে সবার টাকা ফিরিয়ে দিবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক যুবক বলেন, চুক্তি অনুযায়ী রোমানিয়া পৌছার আগে ৫০ হাজার টাকা জমা দেই। কিন্তু তিনি সব টাকা পরিশোধ করে ভিসা নিতে চাপ দিতে থাকেন। পরে ভিসার কাগজপত্র আরেকটি ট্রাভেলসের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসিতে পাঠাই। অ্যাম্বাসি থেকে বলা হয় এটি জাল ভিসা। তখন আমি আবার আমিন রহমান ট্রাভেলসে যোগাযোগ করি। রাজিব নামের একজন তখন জানান, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি এগুলো বন্ধ করে রেখেছে। এজন্য আসল ভিসা পাঠালেও তারা জাল বলে। পরে তাকে বিশ্বাস করে সব টাকা দিয়ে ভিসা বুঝে নেই। কিন্তু এই ভিসা ও টিকিট যে জাল তা আমি বুঝতে পারিনি।’
আরেকজন ভুক্তভোগীর স্বজন জানান, ‘আমার লোককে বলা হয়েছে ২৪ তারিখ ফ্লাইট। এজন্য দুইদিন আগে ঢাকায় গিয়ে করোনা টেস্ট করাতে হবে। এছাড়া ঢাকায় গেলে সেখানকার এজেন্সি থেকে ভিসার কাগজ দেওয়া হবে এবং এজেন্সির মাধ্যমে করোনা টেস্ট করানো হবে। তার কথামতো দুইদিন আগে ঢাকায় গেলে সেখানে একজন লোক দেখা করে বলে বৃহস্পতিবার ২টার দিকে এসে নমুনা সংগ্রহ করবে। আর রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে এক সঙ্গে ভিসা ও করোনার রিপোর্ট দেওয়া হবে। পরে বৃহস্পতিবার নমুনা সংগ্রহ করার পর আমিন ফোন করে বলেন, সব টাকা আগে পরিশোধ করতে হবে। টাকা পরিশোধের পর বিকেল চারটা থেকে আমিন ফোন বন্ধ করে দেন। পরে নমুনা সংগ্রহকারী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বলেন, আমরাও তাকে ফোনে পাচ্ছি না। এরপর থেকে তাকে আর কোনোভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমার স্বজন ঢাকা থেকে আমাদের বিষয়টি জানালে আমরা বাসায় গিয়ে দেখি বাসা তালাবদ্ধ। তার পরিবারের কেউ বাসায় নেই।
এভাবে শতাধিক মানুষকে প্রতারনার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। অবশেষে পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি প্রতারক আমিন। তাকে আজ দুপুরে গ্রেপ্তার করা হয়।