
একুশেনিউজ ডেস্ক::
টানা জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই আঁটঘাট বেঁধে মাঠে থাকতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সে কারণেই দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর নজরদারিও রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছেন, জয়ের ধারা নিশ্চিত রাখতে বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্যদের কপাল পুড়তে যাচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও আগের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বহাল থাকছে। অর্থাৎ ‘বিদ্রোহী’ এসব প্রার্থীদের মধ্যে যারা এখনো স্বপদে বহাল আছেন, তাদের সরিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে নতুন কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।
শনিবার (৭ মে) বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সূচনা বক্তব্যের পর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দেন শেখ হাসিনা।
বৈঠক সূত্র জানায়, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন— আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য আবার আমাদের ক্ষমতায় আসতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য নয়, আমাদের ক্ষমতায় আসতে হবে জনগণের জন্য, দেশের জন্য। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হবে। আমরা চাই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হোক। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছি বলে আমাদের অনেক এমপি-নেতারা জনগণের কাছে যেতে চান না, তারা অলস হয়ে গেছেন।
এ ধরনের নেতাদের পক্ষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলেও ইঙ্গিত দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এরই মধ্যে প্রতিটি সংসদীয় নির্বাচনি এলাকা ধরে মাঠ জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। জরিপের আলোকে প্রার্থী বাছাই করা হবে। যাকে দিয়ে নৌকার বিজয় হবে, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।
এ বছর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণকে মডেল হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী ছিল। কিন্তু আমাদের প্রার্থী জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছে। এ ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ কেউ করতে পারেনি। আমরা সেরকম নির্বাচনই চাই। আমি দেখতে চাই— দেশের মানুষের জন্য এত করলাম, দেশের মানুষ কী দেয়?
কার্যনির্বাহী সংসদের এই বৈঠক নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিনি (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) এরই মধ্যে হোমওয়ার্ক শুরু করেছেন। যাদের জনপ্রিয়তা আছে, যারা জনগণের কাছাকাছি আছে, যারা সুখ-দুঃখে জনগণের পাশে দাঁড়ায় এবং যারা নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে— এমন প্রার্থীই তিনি নির্বাচন করবেন।
বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে কি তাহলে অনেকেই আগামীতে বাদ পড়বেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাদ গেলে যাবে। তার পরাজয়ের গ্যারান্টি নিয়ে তো আর দল তাকে মনোনয়ন দিতে পারবে না।
কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হবে আগামী ডিসেম্বরে। এর আগেই দলের সব মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
টার্গেট দ্বাদশ— জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের দায় নেবে না আ.লীগ
সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনের ব্যাপারে বিশেষ কোনো নির্দেশনা আছে কি না— জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তবে আমরা যারা বিভিন্ন বিভাগীয় টিমে কাজ করি, সেখানে কিছু কিছু জায়গার কথা এসেছে। কোথাও ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি, কোথাও কমিটিই নেই, কোথাও মহিলা লীগের অবস্থা ভালো না, কোথাও যুব মহিলা লীগের কমিটি অসম্পূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা যারা আছেন, তাদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে যেন কমিটি না থাকা জায়গাগুলোতে কমিটি করা হয়। এবং যেসব জায়গায় আংশিক কমিটি রয়েছে, সেগুলো যেন পূর্ণাঙ্গ করা হয়।
ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হলে মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন কবে নাগাদ হতে পারে— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল সংগঠনের (আওয়ামী লীগ) সম্মেলনের আগেই এগুলোর সম্মেলন আয়োজন করা হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার বাস্তবায়নে কী নির্দেশনা এসেছে— জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন— নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকেই আমরা উন্নয়ন কাজ করেছি এবং যেসব মেগা প্রকল্প নির্বাচনি ইশতেহারে ছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের অগ্রগতিতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেও সেভাবেই ইশতেহার করা হবে।
‘তবে এর আগে জাতীয় সম্মেলনে তিনটি কাজ জরুরি। আমাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করার প্রয়োজন হলে সেটিকে হালনাগাদ করা এবং আমাদের ঘোষণাপত্রও হালনাগাদ করা। ঘোষণাপত্রের মধ্যেই তো আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনাগুলো প্রকাশ পাবে। এরপরই আসলে নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু হবে,’— বলেন আব্দুর রহমান।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই এই মাঠ জরিপের কাজটি তদারকি করছেন। এই মাঠ জরিপের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।
টার্গেট দ্বাদশ— জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের দায় নেবে না আ.লীগ
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, শনিবারের বৈঠকে দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। এরপর নেতারা নিজের মতামত তুলে বক্তব্য দেন। প্রথমে বক্তব্য দেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে তৃণমূলের নানামুখী অভিযোগের কথা তুলে ধরেন।
এরপর বক্তব্য দেন সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য শাজাহান খান। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে। বিগত নির্বাচন নিয়ে অনেক কথাবার্তা শুনতে হয়। আগামী নির্বাচনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে কীভাবে আনা যায়, সে ব্যাপারে দলীয় প্রধানের দিকনির্দেশনা চান তিনি।
বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে নিয়ে আসার প্রসঙ্গে অবশ্য বিপরীত মন্তব্য করেন দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের কেন আমরা নির্বাচনে আনব? তারাই নির্বাচনে আসতে চায় না।
এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তুমি চুপ থাকো। তুমি কথা বলছ কেন? সব জানি। তুমি তো ১০ জন নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে হারিয়েছ নিজের লোকদের বিজয়ী করতে। তুমি চাইবা বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভয় পায়, তারাই চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক, যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া যায়। কিন্তু আমি চাই সবার অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হোক।
পদ্মাসেতুর উদ্বোধন আগামী জুন মাসে যথাসময়ে হবে বলেও জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছু মালামাল আটকে যেতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল। কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেগুলো যথাসময়েই এসে গেছে। আমাদের পদ্মাসেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্রও হয়েছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই পদ্মাসেতু তৈরি করেছি। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে জমকালো উৎসব আয়োজনে সেতু উদ্বোধন করব।
আগামী ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সারাদেশে জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজনের নির্দেশনা দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। ওই দিন সারাদেশে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজন করার নির্দেশ দেন। সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে বলেন তিনি। পাশাপাশি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী তথা ডায়মন্ড জুবিলিও দেশব্যাপী জমকালো আয়োজনে উদযাপন করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন তিনি। বলেন, আমরা ক্ষমতায় থাকি আর না থাকি, আমাদের দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠবার্ষিকীতে দলের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রামের তাৎপর্য তুলে ধরতে জাঁকজমকপূর্ণ কর্মসূচি নিতে হবে, যেন নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জানতে পারে।
বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে সাংবাদিকদের সামনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মূলত আগামী জাতীয় নির্বাচন ও আগামী জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে সারাদেশে। আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, বিভিন্ন নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের যারা দলের পদে আছে, সেসব জায়গায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করে মেয়াদোত্তীর্ণ সম্মেলনের কাজ সমাপ্ত করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ সব শাখা, বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা সম্মেলনগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। আমাদের এরই মধ্যে ৪০টি উপজেলায় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে এবং সাতটির মতো জেলায় সম্মেলনের জন্য ১২ মে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আওয়ামী লীগের সম্মেলন কবে নাগাদ হতে পারে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, আশা করছি সম্মেলন ডিসেম্বরে হবে। নেত্রী (দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা) যখন ডেট ফিক্সড করবেন, তখনই হবে। তবে এখন থেকেই দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নির্বাচনি ইশতেহার, ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র— এগুলো তৈরির জন্য তিনি এখন থেকেই কাজ করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন।