• ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৫ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

দেশে দুর্নীতি প্রতিযোগীতায় নেতা ও আমলারা

admin
প্রকাশিত জুন ২৬, ২০২৪
দেশে দুর্নীতি প্রতিযোগীতায় নেতা ও আমলারা

ইমরান আহমদ মিছবাহ : দেশে প্রতিযোগিতামুলকভাবে বাড়ছে দুর্নীতি। আমলা, সরকারদলীয় নেতা কেউই বসে নেই। দুর্নীতি আর দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকে বিশ্বে আরও ২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০ দেশের মধ্যে ২০২৩ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম। যা আগের বছর ছিল ১২তম। এছাড়াও দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরেও পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১০০ নম্বরের মধ্যে এবার বাংলাদেশ ২৪ নম্বর পেয়েছে। গত বছর যা ছিল ২৫। সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) ২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৪৭ থেকে এবার ১৪৯-এ নেমেছে। দুর্নীতি মূল্যায়নের তিনটি সূচক বলছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে।

জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইর ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই)-২০২৩ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সারা বিশ্বে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এদিন বাংলাদেশে টিআইর সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিআইবি নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বক্তব্য রাখেন টিআইবির চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের প্রমুখ।

জানা যায়, বাংলাদেশের এ অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা পুরস্কৃত হন। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেওয়া। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। ড. জামান আরও বলেন, টিআইর সূচকে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে। বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর চেয়ে অনেক কম। এটি অত্যন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। এই অবস্থানের মানে হলো, ‘দুর্নীতি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৮-এর মধ্যে ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে আরও এক পয়েন্ট কমে ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৪ স্কোরে নেমে এসেছে। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে ২৪টি দেশ পূর্ণ গণতান্ত্রিক। ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী।

গত কয়েক বছরে সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এলেও হাসিনা সরকার প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উলটো এসব ঘটনায় দায়ীদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। উল্টো সরকার দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়াও অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয় না। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহশীলতার (জিরো টলারেন্স) ঘোষণা এটা শুধুমাত্র লোক দেখানো। মূলত হাসিনা নিজেই দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি একটি গ্রুপ তৈরী করেছেন। যারা ব্যবসায়ী। তারাই দেশে দুর্নীতি করছে। তারা সকলেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা।

জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। সে কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য সরকার। কিন্তু হাসিনা সরকার যদি দুর্নীতি বন্ধ করতে যায়, তাহলে তাকে গদি থেকে নামানো হবে। কারণ স্বার্থ শেষ হয়ে গেলে কেউ আর হাসিনার পক্ষে থাকবে না। স্বৈরশাসক হাসিনা নিজের ক্ষমতাকে পাকাপুক্ত করতেই দুর্নীতিবাজদের নিজেই আগলে রেখেছেন।

অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান যে পর্যায়ে, তার তুলনায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আর অর্থ পাচারকারীদের সিংহভাগই প্রভাবশালী। আর্থিক খাত, জনবল নিয়োগ এবং বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রবল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এছাড়াও দুদকের স্বাধীনতায় ঘাটতি রয়েছে।

দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৪। এই স্কোর যত বেশি থাকবে, দুর্নীতি তত কম। এক্ষেত্রে গত বছর ছিল ২৫। আগের বছর ছিল ২৬। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে স্কোর কমছে। কিন্তু বিশ্বের সব দেশের গড় স্কোর ৪৩। এক্ষেত্রে বিশ্বের গড় স্কোরের চেয়ে ১৯ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। এর আগে রয়েছে সিরিয়া, মিয়ানমার এবং উত্তর কোরিয়া।

২০২০ সালের নভেম্বরে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যাঁরা টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমলাদের পাল্লাই ভারী। একই দিন বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি আয়োজিত বাজেটবিষয়ক আলোচনায় সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, দেশ থেকে বছরে ৭০০ কোটি থেকে ৮০০ কোটি ডলার পাচার হয়। এ কারণে দেশে ডলারসংকট দেখা দিয়েছে।

দ্ইু সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের জাতীয় সংসদে দেওয়া তথ্যটি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন, দেশে এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বন্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯৭। এর মধ্যে বিসিকের ৩৮২টি, বিসিআইসির ৫টি, বিএসএফআইসির ৬টি চিনিকল, বিএসইসির ৪টি কারখানা। মন্ত্রী অবশ্য বিজেএমসি ও বিটিএমসির অধীন কতগুলো কারখানা সরকার বন্ধ করেছে কিংবা বেসরকারি মালিকদের কাছে লিজ দিয়েছে, তা বলেননি।

প্রশ্ন হলো, সরকার এই কারখানাগুলো লাভজনক করতে চালু রাখতে পারল না কেন? কাদের স্বজনপ্রীতি, ভুল নীতি, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান হলো? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যত আদর্শগত বিবাদই থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে অদ্ভুত মিল আছে। লোকসানের দোহাই দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দাও, না হলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দাও! ক্ষমতার অপব্যবহার, অদক্ষতা ও দুর্নীতির মিশেলে যে প্রশাসন তৈরি হয়, সেটিতে ‘লোম বাছতে গা উজাড়’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। ওপরের ঘটনায় মাত্র কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান আমলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকেরা কী করেন, তার কিঞ্চিৎ তথ্য পাওয়া গেছে জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায়। পাঁচ বছরে কারও কারও সম্পদ বেড়েছে তিন হাজার থেকে চার হাজার ভাগ।

সিলেটের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ছাত্রলীগের নেতা হয়েছেন, এরপর যুবলীগের নেতা হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি খাসজমি দখল করে প¬লল বানিয়ে বিক্রি করেন, টিলা কাটেন। চিনি চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। অতীতে ছাত্রাবাস পোড়ানো ও প্রতিপক্ষকে তাড়ানোর অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই না হলে জনপ্রতিনিধি! দেশে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা চলছে। দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করলে হয়রানি ও নাজেহাল হতে হয়। এটি গণমাধ্যম কর্মী ও নাগরিক সমাজ সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। এটি দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় প্রতিবন্ধকতা। মানুষের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা রয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ, জালিয়াতি এবং সরকারি কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাই এসব পরিস্থিতির পরিবর্তন করে কোনো ধরনের ভয়ভীতি কিংবা অনুকম্পার ঊর্ধ্বে উঠে প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহশীলতা’র ঘোষণা যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর আরও ভালো হতে পারত। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সব সংস্থাকে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে অন্যান্য সংস্থাগুলোর দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেরা সুবিধা নেয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে হবে দুর্নীতি রুখতে। যদি তা না পারেন, তবে তাকে ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করতে হবে। তবেই দেশ দুর্নীতি থেকে মুক্তি পাবে।

লেখক:
ইমরান আহমদ মিছবাহ
বিএসসি
কভেন্ট্রি ইফনিভার্সিটি, লন্ডন।