
এক বালতি দুধে একফোঁটা কেরোসিন পড়লে যেমন গোটা বালতির দুধ অখাদ্য হয়ে যায়, তেমনি সুবিধাভোগী-অবাঞ্ছিত নেতাদের কারণে দলের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি, কোন্দল আর হানাহানি। জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় দলের সাংগঠনিক বাছাই প্রক্রিয়া আর ক্ষুন্ন হয় দলের ভাবমূর্তি।
ঠিক একই অবস্থা হয়েছে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার প্রান্তিক এলাকা জাউয়াবাজার ইউনিয়ন বিএনপিতে। সম্প্রতি ঘোষিত ইউনিয়ন বিএনপি’র এক যুগ্ম আহবায়কের নানা অপকর্মে চরম বিব্রত আহবায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ। বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। আর সর্বোপরী সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। এতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই নেতা আর কেউ নন, তিনি ইউনিয়ন বিএনপি’র যুগ্ম আহবায়ক কামাল উদ্দিন।
জানা গেছে, স্থানীয় জাউয়া গ্রামের কোনাপাড়া নিবাসী রহমত আলীর ছেলে কামাল উদ্দিন জাউয়াবাজার ব্যবসায়ী সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক। তার আপন ছোট ভাই হেলাল উদ্দিন জাউয়াবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় হাবিদপুর গ্রামের জনৈক আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে আবু সাঈদ হত্যার মামলা রয়েছে। এরআগে দোলারবাজার ইউনিয়নের শরীসপুর গ্রামের এক তরুণ ব্যবসায়ীর নিকট থেকে ৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মামলায় হেলাল উদ্দিন গ্রেফতার হয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর সে জামিনে ছাড়া পায়। এ নিয়ে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় হেলালের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। যা বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
বিগত সরকারের আমলে হেলাল উদ্দিনের দাপটে এলাকার মানুষ থাকতো আতঙ্কে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বড় ভাই কামাল উদ্দিনকে বিএনপি’র ইউনিয়ন কমিটির যুগ্ম আহবায়কের পদ ভাগাতে পেরে তার দাপট টিকিয়ে রেখেছে। জাউয়াবাজার গরু হাট থেকেও সে নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছে। ইজারা নিয়েছে পার্শ্ববর্তী কুড়িবিলও। জেলখাটা এই দাগী আসামীর দৌরাত্মে এলাকাবাসী এখনও তটস্হ ।
এ অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে ইদানিংকালে বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ব্যবসায়িক পার্টনার লক্ষণসোম নিবাসী নুরুল আমীন ওরফে ইয়াবা নুরুল গড়ে তুলেছে বিরাট মাদকসাম্রাজ্য। কিছুদিন পূর্বে নুরুলকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ইয়াবা ও মাদকদ্রব্যসহ র্যা ব গ্রেফতার করে। দীর্ঘ কারাবাস শেষে কয়েকদিন আগে সে জামিন পেয়েছে।
স্থানীয় একটি সুত্র জানিয়েছে, হাবিদপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলা থেকে বাঁচার অভিপ্রায়ে বিগত সরকারের সময়ে ছোট ভাই হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে কামাল উদ্দিন বেশ কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তৎকালীন এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের জেলা সদরস্থ বাসায় গিয়ে ফুল দিয়ে আ’লীগে যোগদান করেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর পরই বোল পাল্টে কামাল হয়ে যান বিএনপি’র খাস নেতা। বিগত সরকারের সময়ে কামালের যত দাপট ছিল যুবলীগ সভাপতি ছোট ভাই হেলাল উদ্দিনের ছত্রছায়ায়। আর এখন হেলাল উদ্দিন দাপট দেখিয়ে চলছেন বড় ভাই কথিত বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিনের যোগসাজশে।
বিএনপি’র স্হানীয় মিজান বলয়ের লোকজন মনে করেন, কামাল উদ্দিনের পদ-পদবির প্রভাব ব্যবহার করছে তার ছোট ভাই ডেভিল হেলাল উদ্দিন। হেলাল এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত সরকার বিরোধী নানা মন্তব্য করে যাচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে এই পরিবারটি কোন রাজনৈতিক পরিবার নয়। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে এক ভাই অপর ভাইকে ব্যবহার করে টাকা কামাই করছে।
শুধু তাই নয়, নিজে যুগ্ম আহবায়ক হয়ে কামাল উদ্দিন জাউয়াবাজারে জনৈক সাজ্জাদুর রহমানের দোকানকোটা ভাড়া নিয়ে বিএনপি’র দলীয় অফিস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কার্যতঃ এখানে কামাল উদ্দিন ও সাজ্জাদুর রহমানরা বসে মাদক সেবন করেন। আর ইয়াবা নুরুল গংদের মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম ও দালালীর ভাগ-বাটোয়ারার কাজে ব্যস্ত থাকেন। কারণে-অকারণে এই অফিসে এনে নিরীহ লোকজনদের বিচার-সালিশের নামে শাস্তি দেয়া হয় বলে, স্থানীয় জনগণ কামাল উদ্দিনের এ অফিসকে এখন ‘আয়নাঘর’ নামে অভিহিত করে থাকেন। এ নিয়েও এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
ইউনিয়ন বিএনপি’র যুগ্ম আহবায়ক কামাল উদ্দিন-এর এসব অপকর্মে স্থানীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ পড়েছেন বিব্রতকর অবস্থায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মতো ছাতকেও মিলন গ্রুপ ও মিজান গ্রুপ নামে বিএনপি’র দু’টি ভিন্ন বলয় রয়েছে। বিগত কয়েকদিন আগে যখন জাউয়াবাজার ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়, তখন মিলন গ্রুপের বলয় থেকে কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় ও আওয়ামী আমলে অর্জিত অর্থের বদৌলতে কামাল উদ্দিন যুগ্ম আহবায়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ ভাগিয়ে নেন। কিন্তু কার্যতঃ তিনি জাতীয়তাবাদী ঘরাণার লোক নন। একজন ‘নন-পলিটিক্যাল’ ব্যক্তি হিসেবে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল ও ছোট ভাইকে রক্ষা করতে তিনি মূলতঃ বিএনপিতে জুৎসই জায়গা করে নিয়েছেন। তবে তৃণমূল বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা কামাল উদ্দিনের বিএনপিতে সংযুক্তিকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, কামাল উদ্দিনরা জাতীয়তাবাদী শক্তির কোন উপকারে আসতে পারেনা। ওরা চিহ্নিত স্বার্থান্বেষী। ‘ডেভিল ফ্যামেলি’র কোন সদস্য শহীদ জিয়ার আদর্শের দলকে ব্যবহার করে কলুষিত করবে, তা হতে দেয়া হবে না। আমরা যে কোন মূল্যে এ অনাচার রুখবো।’
কয়েকজন নেতাকর্মী বলেছেন, কথিত কামাল উদ্দিন সাম্প্রতিক সময়ে ছাতকে মূলতঃ বিএনপি’র মিলন গ্রুপের কর্মী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু সুনামগঞ্জ-৫ আসনে যদি কলিম আহমদ মিলন ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হন, তবে জাউয়াবাজার এলাকায় কামাল উদ্দিনের অব্যাহত অপকর্মের কারণে সমুহ ক্ষতির আশংকা রয়েছে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। চরম বিতর্কিত এ ব্যক্তিকে নিয়ে বর্তমান উপজেলা আহবায়ক কমিটির অনেক সদস্যও পড়েছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। তারা মনে করেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব বিষফোঁড়াকে ঝেড়ে ফেলা দলের জন্য উত্তম।
অপরদিকে মিজান গ্রুপের নেতা হিসেবে পরিচিত উপজেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য, জাউয়াবাজার ইউনিয়ন বিএনপি’র সাবেক সভাপতি এনামুল হক পীর বলেন, কামাল উদ্দিন বাস্তবে বিএনপি ঘরাণার কেউ না। আমরা বিষয়টি কেন্দ্র ও জেলা উপজেলার নেতবৃন্দের নজরে দিয়েছি। মূলতঃ কামাল উদ্দিন একজন ব্যবসায়ী। নানা অপকর্মের সাথে জড়িত বলে তার বদনামও রয়েছে। কিন্তু তারপরও রহস্যজনক কোন এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সে বিএনপিতে স্থান করে নিয়েছে। যা দলের জন্য খুবই খারাপ নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমি মনে করি এটা তার ব্যবসায়িক ও পারিবারিক স্বার্থ হাসিলের একটা ধান্ধা। এসবকে ছেঁটে ফেলা দলের জন্য স্বস্তির। দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আশা করবো, এসব অপকর্মের হোতাদের দলে না রাখাই উত্তম।’