অধ্যাপক বাছিত ইবনে হাবীব: বাষট্টিখানা ঝাল টক মিষ্টি বর্ষাবসন্তের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ একজন ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশী কবি মোহাম্মদ ইকবাল। পেশায় প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী হয়েও তিনি কবি।একজন বড়ো মাপের কবি। ইতোমধ্যে চারখানা হৃষ্টপুষ্ট কবিতাগ্রন্থ মুক্তি পেয়েছে তার বিশ্বাসী ভাবধারার কবি হৃদয় থেকে। মহান সৃস্টিকর্তা আল্লাহতা’ লার ওপর অটল অবিচল বিশ্বাসী এই কবি ২০১৬ সালে প্রথম কবিতাগ্রন্থ’ স্রস্টার শৈল্পিক হাত’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যজগতে তার প্রতিশ্রুতিশীল প্রবেশ নিশ্চিত করেন। তারপর তিনি লিখেছেন রোমান্টিক কবিতাগ্রন্থ। প্রকৃতি প্রেমের বয়ানসমৃদ্ধ কবিতাগ্রন্থসহ চারখানি মৌলিক কবিতার বই। তার যৌথ কবিতাগ্রন্থের সংখ্যাও চারটি। সব মিলে তিনি একজন মস্ত কবি। প্রখর জীবনবোধে আচ্ছন্ন জীবনঘনিষ্ঠ কাব্যভাষা তার কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সুস্থ সমাজ বিনির্মানে তার শব্দপাত অনাবিল অবিরত। এজন্যে কাব্যকৃতি ধারণ করে আছে তার চিন্তাচেতনার বিশাল অংশ।কবিতার সাথে তার সারাজীবনের মিতালি বেশ প্রগাঢ়। এই কবির আজকের আলোচ্য কবিতাগ্রন্থ ‘সংবিধিবদ্ধ নসিহত’। শিরোনাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে ষাটোর্ধ জীবনের অপরাহ্নে দাঁড়িয়ে তিনি পরের প্রজন্মের কাছে তার দীর্ঘ জীবনোপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতার ভাষায় তার মূল্যবান কথামালা রেখে যেতে চান। একজন প্রকৃত কবি যে বহুবিধ বোধ ও চেতনাস্রোতে ভাসতে ভাসতে রচনা করেন একখানা গ্রহণযোগ্য কল্যানবাহী কবিতাগ্রন্থ মোহাম্মদ ইকবালের ‘সংবিধিবদ্ধ নসিহত’ বইটি এ কথার জ্বলন্ত প্রমান বহন করছে।
একজন সচেতন কবি হিসেবে তিনি কখনো অসুস্থ রাজনীতির সমালোচনা করছেন। কখনো দেহবাদ ও ভোগবাদের দিকে তার বয়ান স্পষ্ট করছেন। কখনো আশাবাদের বীজ বপন করে পাঠককুলকে অনুপ্রাণিত করছেন। মাঝেমধ্যে বিকৃত সমাজ ব্যবস্থার বিবর্ণ রূপ তোলে ধরছেন। ঈর্ষাপরায়ন মানুষের সমালোচনা করছেন। একাত্তরের বিজয়গাঁথা স্মরণ করে দিচ্ছেন। তার কলম থেকে ঝরছে রোমান্টিক ঝরনাধারা। দেশপ্রেম তাকে আন্দোলিত করছে একেবারে ভেতর থেকে। মানবতাবাদী চেতনাবাহী এই কবি চান কিছু পরিশুদ্ধ হৃদয়বান মানবনন্দন। চান পন্কিলে ডোবা মানুষের বিশুদ্ধ শুভ্রতা। জীবন বাস্তবতার নির্মোহ ছবি এঁকেছেন তার অনবদ্য রচনা ‘দোয়াত’ কবিতায়। একটি সুন্দর প্রতীকি ব্যন্জনায় রচিত কবিতাটির প্রতিটি পঙ্তি পাঠকের জন্য একেকটি রুচিসম্মত প্রাপ্তি। কবিতা লিখেছেন দাম্ভিক অহংকারীর বিরুদ্ধে। আশাবাদী চেতনার এই কবি মাঝেমধ্যে হতাশার চিত্র এঁকেছেন গুণী কবির মতো। রচনা করেছেন নিটোল প্রেমের অনেকগুলো নিখুঁত কবিতা।
কখনো নস্টালজিক হয়েছেন পরিযায়ী পাখির মতো। যেন কবি দিলওয়ার তার সামনে-
‘বন্ধুরা জানো কি
ভুল নেই পাখিদের নিজেদের লক্ষ্যে
উড়ে যায় বহুদূর প্রগতির ঐক্যে
বন্ধুরা জানো কি?
(দিলওয়ার)
এই কবি বেশ যুগ সচেতন। এ জন্যে প্রাচীন যুগের
মৃত ভাষার স্থান তার কবিতায় নেই। কিছু উদাহরণ দেয়া যাক-
স্মার্ট ঘড়ির বিরক্তিকর অ্যালার্ম ঘুমকে শূণ্যে তুলে মাটিতে আছাড় দিয়ে জানান দেয় আজ / সোমবার
(কবিতা : স্মার্ট ঘড়ি)
ছায়াগুলোকে সুকৌশলে পোষ মানিয়েছি / প্রতি রাতে এদের ছেড়ে দিই রাতের উন্মুক্ত উঠোনে।
কবিতা: ছায়া
চিকিৎসকের সামনে হৃদপিণ্ডটি একটি মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছুই নয়। -( কবিতা- হৃদয়বিদ্যা)
চিঠিগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হলে যুবতী বাতাসে ওড়ে ভালোবাসার নষ্টালজিয়া সিম্ফনি।
(কবিতা : তুষার)
অতৃপ্তির আগুনে বোধের পাটাতন উত্তপ্ত দোযখ। (কবিতা: তলিয়ে যাওয়া)
যুবতী রাতের মখমলি নেকাব লুটে নেয় চাঁদের স্নিগ্ধ আলো।
(কবিতা : চতুর্থ প্রজন্মের কাব্য)
তড়ে আসে মিথ্যে অহংবোধের বিষধর সাপ।
(কবিতা : এমন হওয়ার কথা ছিল কি?)
শুধু তাই নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বের হালচালের খবর ভালোই রাখেন এই কবি। ইরানের বিজ্ঞানী খাশোগি হত্যা গোটা বিশ্বের জন্য লজ্জা ও মর্মান্তিক ঘটনা। এই কবি এই ঘটনাটি পৃথিবীর মানুষকে স্মরণ করে দিতে লিখেছেন-
দম্ভের পলেস্তরার নিচে কি ঢাকা পড়ে মুছে যাবে ভাগ্যাহত খাশোগির নাম?
(কবিতা : দূতাবাসে যমদূত)
একনিষ্ঠ এই প্রেমিক কবির প্রেমের কবিতা পাঠকমনে মানবপ্রেমের ঝড় তুলবে সক্ষম যেমন:
আজ শুধু তোমাকেই পড়বো/ তোমাকে খুঁজতে ভাসবো মেঘের ভেলায়/ কাশবনে যাব/ দেখবো তোমার নামের অক্ষরগুলো ছেড়ে দিলে কী করে ওগুলো কাশফুল হয়।
(কবিতা : আগমনি বার্তা)
নষ্ট মানবচরিত্র ও বিকৃত মানবসমাজ চিত্র এঁকেছেন বেশ মুন্সীয়ানার সাথে –
নির্বাসনে পাঠিয়ে বিশুদ্ধ শুভ্রতা / দাঁত বের করে হাসে/ পঙ্কিলে ডোবা নির্লজ্জ মানুষের দল।
(কবিতা : পঙ্কিলে ডোবা মানুষ)
‘ইলিশের স্বাদ সেই কবে খুন হয়ে গেছে হাইব্রিড খাবারের চাকচিক্যময় বিলাসে।’
(কবিতা : মানুষ)
অসুস্থ রাজনীতির কাব্যিক সমালোচনা এই কবির সৎসাহসের পরিচয় বহন করছে। যেমন:
‘ক্ষমতাধরদের ভর করে আছে অসুরের অশরীরী আত্মা।’
(কবিতা: আঁধার বন্দনা)
হিংসা, প্রতিহিংসা, ঈর্ষামুক্ত সুস্থ সুন্দর সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা এই কবি কত সুন্দর করে বলেছেন:
“পড়শির ঈর্ষা এবং তোমার অভিজাত সৌন্দর্যে আমি পুড়বোই।”
(কবিতা: ঈর্ষা)
তাছাড়া বঙবন্ধু ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা নিয়ে স্বাধীন কাব্যিক মতামত ব্যক্ত করেছেন এই দেশপ্রেম ও রাজনীতি সচেতন কবি।
নারীর মর্যাদা রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর এই কবি।নারীদেহের রূপসৌন্দর্যকে গোপন সিন্দুকের সাথে তুলনা করে লিখেছেন :” সিন্দুকহারা নারী বৃক্ষের মতো আবারও সবুজ হতে পারে না।”
(কবিতা : বৃক্ষ এবং নারী)
এই কবির দেখার চোখের প্রশংসা আলাদাভাবে করতেই হয়। তার দেশ মাটি হাওর প্রেমের অনবদ্য স্মৃতিবাহী চরণগুলো-“পুঁটিমাছ মুখে বক/পানকৌড়ির দুরন্ত ডুবসাঁতার/হাওর জুড়ে বালি ল্যান্জা সরালি হটটিটি শামুক ভাঙাধানের পানমুরগি বেগুনি কালেমের ঝাঁক।”
(কবিতা- মগজের প্ল্যাটফরমে স্মৃতির রেলগাড়ি)
পুরো বই থেকে একটিমাত্র চরণ উল্লেখ করেও বলা যায় মোহাম্মদ ইকবাল একজন উঁচু মাপের কবি। যেমন- “ধূমায়িত চায়ের পেয়ালার কার্নিশ বেয়ে নেমে যায় গেরুয়া সকাল”।
(কবিতা : গেরুয়া)
ভালোবাসা -প্রেম বিষয়ক একটি চরণ পাঠকের হৃদয় হরণ করার মতো- “অন্তরে তুমি রেশমি কোমল জাফরানি মৌচাক।”-( কবিতা: ভালোবাসার চালচিত্র)
এই বইয়ের শিরোনাম কবিতাটিতে কবিদের প্রতি কবির নসিহত বা উপদেশ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। একজন পরিপূর্ণ কবিই উৎসাহিত করতে পারেন তার অনুগামী তরুণ কবি প্রজন্মকে। লিখেছেন : কবিতা থামলেই কোটি মানুষের আহাজারি/ কবিতা থামলেই মাথা চাড়া দেবে অজস্র অনাচার/ কবিতা থামলেই পঙপালের তাড়া/ কবিতা থামলেই বিভীষিকা মহামারি।
(কবিতা : সংবিধিবদ্ধ নসিহত)
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে কবি কালাম আজাদের সেই চরণগুলো “তাই বলি বন্ধুরা কবিতা লিখুন/ এখনো পৃথিবীতে কবিতা নিপুণ। “
স্রস্টাপ্রেমে গভীরভাবে ডুবে থাকা এই কবির আরাধ্য। বিশ্বাসের এই জায়গায় তিনি একদম অনড় অটল। এই আলো ঝলমল পৃথিবীতে বসবাস করেও তিনি মাটির আয়না কবিতায় লিখেছেন : পোড়া মাটির নান্দনিক অলংকার/ মাটির ঘর এবং মাটির বিছানা।
কবির ইহ-পরকালীন চেতনার সর্বাংশে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতালার অস্তিত্ব সুস্পষ্ট। যেন ইহ পরকালের শ্রেষ্ঠ কিতাবের সেই আয়াতগুলোর কাব্যিক অনুবাদ করেছেন হুয়াল আউয়ালু ওয়াল আখিরু ওজজাহিরু ওয়াল বাতিনু ওয়াউল্লাহু আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির। ‘ফুল ফোটানোর কারিগর” কবিতায় লিখেছেন : আদিতেও আমি অন্তেও আমি/ আমি অবিনশ্বর! / রহস্য আমি / আমাতেই ঈশ্বর পরমেশ্বর।
যেকোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে ছাপাখানার ভূত, প্রুফ রিডারের চোখ ফাঁকি এগুলো স্বাভাবিক। যেমন বৃক্ষ এবং নারী কবিতায় ‘যেনে’না হয়ে জেনে হবে। আমার বিশ্বাস কবিতায় :অপ্রার্থিব’ নয় ‘অপার্থিব: হবে। ‘পরসা’ না হয়ে ‘পসরা’ হবে। অত্যন্ত মায়াবী এই আধুনিক কবি তার ছয় ভাইবোনকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন। এলবাম সাইজের বইটির ব্যতিক্রম প্রচ্ছদ, অন্তর্গত অল্যকরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এর বিনিময় মূল্যও বেশ যৌক্তিক।
তরুণ যুবা বৃদ্ধ সবার শিল্পতৃষ্না পূরণে বইটি বেশ কার্যকর হবে বলে মনে হয়। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করি। ভবিষ্যতে তাঁর বিশাল সৃজনী হৃদয় থেকে আরো অনেক অনেক কাব্যসুবাস ঝরবে আশা করি।
অধ্যাপক বাছিত ইবনে হাবীব:
কবি, অধ্যাপক, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক