• ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৫ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

কোটা আন্দোলন: এতো হত্যা কেন?

admin
প্রকাশিত জুলাই ২৫, ২০২৪
কোটা আন্দোলন: এতো হত্যা কেন?

ইমরান আহমদ মিছবাহ: চারদিকে গুলাগুলি, বারুদের গন্ধ। রাজপথ রঞ্জিত। লাশের সারি। মিছিলে-স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত। মানুষের আহাজারি, কাপছে আকাশ। ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় চারদিকে শুধু হাহাকার, ভয়। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাস্তায় নেমে এসেছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী, চলছে বিদ্রোহ। বাড়ছে লাশের সংখ্যা।

কেন এতো হত্যা? শিক্ষার্থীরাতো কাউকে গদি থেকে নামাতে চায়নি, তারা চেয়েছে তাদের দাবি। বৈষম্য দূর করার দাবি। চাকরির নিশ্চয়তা। তাদের সরকার এতো কঠোর হলো কেন? শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা সংস্কারের দাবিতে তাদের আন্দোলন শুরু হলেও এখন তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও আক্রমণাত্মক ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সরকার প্রথমে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের নিরস্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং ক্ষোভের আগুন রাজধানী থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করে। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টার্গেট করে আক্রমণ পরিচালিত হতে থাকে। পুলিশ ফাঁড়ি, থানা এমনকি বিভিন্ন স্থাপনাও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প¬াজার মতো সংবেদনশীল স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সমর্থনে সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সামিল হয়। সরকার পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি বিজিবি নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।

প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা চাইছে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা সংস্কার। এটা তো সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়, তাহলে কেন এমন সরকারবিরোধী প্রবল আন্দোলনে রূপ নিল? কেন শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে উঠল? কেন সবখানে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ল? ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শিতা ও হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির দাবি-দাওয়া ও ক্ষোভের ব্যাপারে সরকারের এক ধরনের উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য রয়েছে। এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অহমিকা ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে বিরোধী দলসমূহের ব্যর্থতা। উপেক্ষা দেখিয়ে কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে অতীতের সব আন্দোলনকে দমন করার ‘সাফল্য’ থেকে সরকার এমনটা করতে উৎসাহী হয়েছে নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৭ কোটির বেশি মানুষ চাকরি এবং কর্মমুখী নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে ১৫ লাখ, যা মোট কর্মক্ষম মানুষের ১ শতাংশের মতো। এই অল্প কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সরকারের ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে দাবানলে পরিণত হয়েছে, হয়ে গেছে জাতীয় ইস্যু।

সরকার প্রথমেই যদি আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতো তাহলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সরকার বলতে পারত, আমরা তোমাদের দাবির প্রতি একাত্ম। তোমাদের দাবি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে আমরা উচ্চ আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করব। রায় প্রত্যাশা মতো না হলে নির্বাহী আদেশে কিংবা সংসদে আইন পাস করে কোটাব্যবস্থা যৌক্তিক পর্যায়ে পুনর্র্নিধারণ করব। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও এমন কথা বলতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, তোমাদের হয়ে আমি আইনি লড়াই করব। না পারলে গদি ছেড়ে দেব। কিন্তু তেমন কোনো কথা ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শোনা যায়নি। বরং নানাভাবে আন্দোলনকারীদের ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। আন্দোলনকারীদের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ‘রাজাকার’, ‘শিবির’, ‘বিএনপি’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হয়েছে।

১৪ জুলাই দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত সংবাদের একাংশ এমন-আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সরকার একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনকে কেন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে? কোটাবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই।’ ঠিক এর পরদিন ১৫ জুলাই কোটা আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ! এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ৫০ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন। এর পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়য়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। অনেক স্থানে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। বাড়তে থাকে সংঘাত।

সরকার সবচেয়ে বড় ভুল করেছে আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-যুব সংগঠন কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়েছে। ছাত্রীদেরও নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। কোথাও কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়েছে। বর্তমানের এই শক্তিশালী প্রযুক্তির যুগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এই হিং¯্রতার ছবি ও ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের এই দস্যুতার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। এর ফল হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের হিংসার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারা তেমন কারও সহানুভূতি পাননি।

এমনকি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে, তাদের হাতেই খুন হয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নামে যে শিক্ষার্থীকে পুলিশ একেবারে সামনাসামনি টার্গেট করে গুলি করেছে, ওই ঘটনা জনবিক্ষোভকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একজন সাহসী শিক্ষার্থীকে এভাবে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা যারাই দেখেছে, তারাই শিউরে উঠেছে! পুলিশের এ কোন বর্বর আচরণ? ওই প্রতিবাদী ছেলেটিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারত। ছত্রভঙ্গের জন্য টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করতে পারত। তা না করে সরাসরি গুলি করেছে। তাও একটি নয়, পর পর তিনটি। এই দৃশ্যটি শুধু শিক্ষার্থী নয়, সারাদেশের মানুষকে পুলিশের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ফলে পুলিশ এবং সরকারি দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের হিংসার শিকার হয়েছেন।

সর্বশেষ, ১৮ জুলাই থেকে দেশব্যাপী যে নাশকতা, ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রাণঘাতী সংঘাতের নজির দেখ গেল, তার দায় বর্তায় বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অনুসারীদের কাঁধে। রাজধানীসহ সারাদেশের আজ যে চিত্র, তাতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে হয় না। সবখানে ক্ষোভের আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। কয়েকজন পুলিশেরও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপে বসার প্রস্তাব দিয়েছে। এর জবাবে আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে বলেছেন, পুলিশ ও সরকারি দলের সদস্যদের হাতে নিহতরা যদি জীবিত হন, তাহলেই কেবল আলেচনায় বসা হবে! এটা যে আন্দোলনকারীদের তীব্র ক্ষোভের কথা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের ক্ষোভকে অন্যায্য বলা যাবে না। এক পর্যায়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, জনমানুষের নিরাপত্তা এবং নাশকতা বন্ধে জারি করা হয় কারফিউ।

উল্লিখিত বিষয় ও ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমিতে যে সহিংস সংঘাত আর ধ্বংসের তাণ্ডব চলেছে, তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো দায় নেই। দায় সম্পূর্ণ সরকারের। এ দায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের। তাদের উস্কানীতেই ঝড়ে গেছে একশোর উপরে প্রাণ। এ হত্যাকান্ডের দায় সরকারকে নিতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনভাবেই এ দায় এড়াতে পারেন না। হত্যাকান্ডের দায় নিয়ে হাসিনার পদত্যাগই এখন সমাধান।

লেখক
ইমরান আহমদ মিছবাহ
বিএসসি
কভেন্ট্রি ইফনিভার্সিটি, লন্ডন।