• ১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২১শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

ভয়াল সেই ২ আগস্ট: কী ঘটেছিল সিলেটের আখালিয়ায়!

admin
প্রকাশিত আগস্ট ৩, ২০২৫
ভয়াল সেই ২ আগস্ট: কী ঘটেছিল সিলেটের আখালিয়ায়!

মোহাম্মদ জহির খান:: 
২ আগষ্ট শুক্রবার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়ায় গুমোট পরিবেশ সিলেটে। জুম্মার নামাজ পড়ে বাসায় আসা মাত্রই মেসের দায়িত্বশীল ভাই জানালেন উনারা আজও আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। উনাদের সাথে যাবো কি না বলতেই এক বাক্য রাজি হয়ে গেলাম। বিগত কয়েকদিন বিচ্ছিন্নভাবে শহরের অনেক জায়গায় মিছিল আন্দোলনে থাকলেও আজ বাসার সবাই একসাথে যাচ্ছেন বলেই আরও সাহস পেলাম।

নগরের আম্বরখানা থেকে আখালিয়াগামী দুটি সিএনজি ভাড়া করে রওনা দিলাম সিলেটের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম হটস্পট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেখানকার উত্তাল পরিস্থিতির কারণে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যেতে হল আমাদের। তখনও জানতাম না জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি কয়েকঘন্টা পরেই।

দুপুর ৩টা বাজার আগেই খন্ড খন্ড মিছিল-স্লোগানে আখালিয়া এলাকায় জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনকারীরা। রক্তে আগুন ধরা স্লোগান- জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো, স্বৈরাচারের গদিতে, আগুন জ্বালাও একসাথে, আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই, লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে, দিয়েছি তো রক্ত আরও দেব রক্ত, আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আমরা যেখান থেকে দাড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলাম তার ঠিক কয়েক গজ সামনেই অর্থাৎ মদিনা মার্কেটের দিক থেকে পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সাজোয়া যান নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগুতে থাকে।

এরপর বেলা তিনটার দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সুরমা আখালিয়া এলাকায় গণমিছিলের জন্য একত্রিত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষজনও সেখানে জড়ো হন। বিকেল চারটার দিকে গণমিছিল নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী-জনতা বের হতে চাইলে পুলিশ বাঁধা দেয়। তখন পুলিশি বাঁধা অতিক্রম করে আন্দোলনকারীরা সামনে এগিয়ে যায়। গণমিছিলটি সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক হয়ে নগরীর প্রবেশমুখের আখালিয়া এলাকার মাউন্ড এডোরা হসপিটালের সামনে পৌঁছামাত্রই পুলিশ মিছিলের পেছন দিক রাবারবুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এরপরই পুলিশ সাউন্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালসহ পুরো সুরমা আবাসিক এলাকা। এরপর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে সামনের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। এতে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে পুলিশের হামলার শিকার হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আশপাশের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় প্রবেশ করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একাংশ আখালিয়া নয়াবাজার এলাকার গলিতে, একাংশ মাউন্ড এডোরা হসপিটালের গলিতে, একাংশ কালীবাড়ি এলাকার গলিতে, একাংশ মদিনা মার্কেট এলাকার গলিতে প্রবেশ করে। এসময় সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক বন্ধ করে স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। বিকেল চারটা থেকে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের এই সংঘর্ষ শুরু হয়।

ইতিমধ্যে প্রাণে বাঁচতে আন্দোলনকারী অনেকেই মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে ঢোকে পড়ে। এসময় পুলিশের হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করা হয়- যারা হাসপাতালে ঢুকেছে তাদের যেন বের করে দেয়া হয়। নতুবা পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সময় হাসপাতালের কর্মকর্তারা এসে পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তারপরও ওই এলাকায় পুলিশ অনেক সময় অবস্থান করে। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফের বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় পুলিশকে ধাওয়া দিয়ে তারা সেখান থেকে কিছুটা সরিয়ে দেয়।

আন্দোলনকারীরা বলেন- পুলিশ শুধু টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়েনি তাদের লক্ষ্য করে গুলিও ছুড়েছে। পুলিশের ছোড়া ছিটাগুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন তারা। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ওই এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়। এ সময় কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। গোলাগুলির শব্দের কারণে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাসাবাড়ির লোকজন প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন।

আখালিয়ার মাউন্ড এডোরা হাসপাতাল এলাকায় সংঘর্ষের পর মদিনা মার্কেটের অদূরেও হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে পুলিশ সেখানে টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। এতে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে ওইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই সড়কে যানবাহন একেবারেই চলেনি। সংঘর্ষের সময় পুলিশ আখালিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আন্দোলনকারীসহ অনেককেই গ্রেফতার করে।

বিকাল ৪টার দিকে ফের আখালিয়া এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ বছর বয়সী এক শিশু, ২০ জন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৫০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওইসময় পুলিশের ছোড়া বুলেট ও ঝাঝালো টিয়ারশেলের গ্যাস থেকে বাঁচতে দৌড়ে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের বাইরের গ্যারেজের দিকে আশ্রয় নেই। কিন্তু সেখানেও গিয়ে হানা দেয় পুলিশ। উপায়ন্তর না দেখে দেয়াল টপকানোর জন্য লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নেই কিন্তু তার আগেই ছুটে আসা ঘাতকের বুলেটে পড়ে যাই দেয়ালের অনেক উপর থেকে। সাথে সাথেই ভেঙে যায় দু’পায়ের গোড়ালি। ভয়ানকভাবে প্রায় ছয় টুকরো হয়ে যায় উরুর উপরের হাড়।

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝতে না পেরে কোনোমতে ডাক দেই দৌড়ে থাকা পথচারীদের। সেখান থেকে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তড়িঘড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় গলির ভেতর এক বাসায়। প্রচন্ড আঘাত আর ব্যাথায় কাতরাতে থাকলেও বাইরে গুলাগুলির জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। প্রায় ঘন্টাখানেক পর অপরিচিত এক মা ও দুই ভাইয়ের সহযোগিতায় কোনমতে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে এসে পৌঁছাই।

পথিমধ্যে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনকারী কি না এমন তল্লাশি পেরিয়েও আসতে হয়। তখন ওই মা পুলিশকে বলেন, আমার ছেলে ভবনে কাজ করতে গিয়ে পড়ে গেছে, তাই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এমন মিথ্যার আশ্রয় না নিলে সেদিন আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু হাসপাতালে আসা মাত্রই বাধে বড় বিপত্তি! আন্দোলনকারী সনাক্তে জরুরি বিভাগজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গ্রেফতার আতংক। উপায়ন্তর না দেখে পরিবারের সদস্যরা নিয়ে যান গ্রামীণ হসপিটাল নামের একটি প্রাইভেট মেডিকেলে। সেদিন রাতেই ঝুকিপূর্ণ বড় সার্জারির দুই দিন পর ধীরে ধীরে হুশ ফিরে আসে।

এর আগের রাতে গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সিলেটবাসীকে মসজিদে জুম্মার নামাজ শেষে দোয়া-কবর জিয়ারত, মন্দির, গির্জাসহ সকল প্রার্থণালয়ে প্রার্থনার আয়োজন ও ছাত্র-জনতা মিলে গণমিছিলের আহবান করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শাবিপ্রবি এবং সিলেট সমন্বয়ক টিম। ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-জনতাকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের আহবান জানান তারা। আন্দোলনের সমন্বয়ক সূত্রে জানা যায়, এদিনের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষজনও ভয়াবহভাবে আহত হয়েছেন। এই আহত অবস্থায় অনেক শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে।