মুফতি তানজিল আমির::
আজ ১৭ রমজান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান ইতিহাস বিখ্যাত ‘বদর যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল। এ দিনে বদর প্রান্তরে রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কার কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র যুদ্ধ হয়, ইতিহাসে তাই বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ।
সেদিন বদরের প্রান্তরে ইমান ও কুফর, ন্যায় ও অন্যায়ের এক অন্যরকম ইতিহাস রচিত হয়, যা যুগ যুগ এক আল্লাহতে বিশ্বাসী মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে। সম্মান-অপমান আল্লাহর হাতে।
এ বিশ্বাস ও চেতনা লালন করে পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই মুসলমানরা অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, তারা সংখ্যায় বা সম্পদে কম হলেও আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছেন।
পক্ষান্তরে আল্লাহর ওপর ভরসাহীন অঢেল সম্পদ ও প্রচুর সৈন্যসামন্তের বহরে সুসজ্জিত মুসলমানদের পরাজয়ের বর্ণনায় ইতিহাসের পাতা ভরপুর হয়ে আছে।
বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানে জানা যায়, মদিনায় সফলভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মক্কার কোরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসায় লিপ্ত হলো। আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই ও ইহুদিরা যড়যন্ত্র শুরু করল। মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি শর্ত ভঙ্গ করল। কোরাইশরা তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় যুদ্ধের ঘোষাণা দিল। নবিজিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার নিকৃষ্ট পরিকল্পনা ও নীলনকশা তারা আঁকল। কাফেরদের রণ প্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানদের অপপ্রচার, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ঐশী বার্তা, মক্কাবাসীদের ক্ষোভ এবং কাফের দ্বারা মদিনা আক্রমণ ঠেকাতে মুসলমানরা মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে ১৭ রমজান কাফেরদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উপনীত হন।
হিজরি দ্বিতীয় সালের ১৭ রমজান ‘আশহুরে হুরুম’ বা যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস চতুষ্টয়ের অন্যতম রমজানেই মদিনা আক্রমণ করে বসে কাফেররা। আর তার বিপরীতে মুসলিমরা গ্রহণ করেছিল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের কৌশল। সত্য-অসত্যের চূড়ান্ত ফয়সালাকারী ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ হলো এভাবেই। আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাসী মুসলমানদের অস্ত্র ছিল মাত্র তিনটি ঘোড়া, ৭০টি উট, ছয়টি বর্ম ও আটটি তলোয়ার। রসদ কম মনে হলেও বিজয় লাভের তাদের প্রধান উপকরণ ছিল ইমানি শক্তি।
এ ঐতিহাসিক যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের অর্জন ছিল-আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, বিশ্ব জয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস রচনা।
প্রথম সামরিক বিজয়, কোরাইশদের চরম পরাজয়। মিথ্যার ওপর সত্যের জয়।
রাসুলে আকরাম (সা.) তাঁর সাহাবাদের জিহাদ সম্পর্কে নসিহত ও উদ্দীপনামূলক ভাষণ প্রদান করলেন। এ মহাপরীক্ষায় সৃষ্টিকর্তার ওপর অবিচল বিশ্বাস রেখে ধৈর্য অবলম্বন করা এবং অবিচল থাকাই জয়লাভের একমাত্র ও প্রধান উপায়-এ বাণীই তিনি সাহাবিদের দিলেন।
হক ও বাতিলের লড়াইয়ে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান জানবাজি রেখে কাফেরদের মোকাবিলায় জয়লাভ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে ৭০ জন মুশরিক নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুমিন বীর সেনানী শাহাদতের অমীয় সুধা পানে অমর হন।
যেহেতু সেদিন কাফের-বেইমানদের সঙ্গে ইসলামের পার্থক্য সূচিত হয়েছিল তাই এ দিবসকে ইয়াওমুল ফুরকানা বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়।
বদরের এ ঘটনা থেকে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো, মুসলিম উম্মাহ এমন একটি জাতি, যে নীরবে নিভৃতে অত্যাচার-অনাচার-জুলুম সহ্য করাকে ভয়াবহ গোনাহ মনে করে। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় কর্তব্য।
লেখক : তরুণ আলেম ও ধর্মীয় গবেষক