দু’বছর আগে সিলেট সিটি করপোরেশনের মরণফাঁদে পড়ে আহত হয়েছিলেন সিলেটের বিখ্যাত কবি আব্দুল বাসিত মোহাম্মদ। তারপর অনেকদিন পড়েছিলেন হাসপাতালের বেডে। বাসায় ফিরলেও সুস্থ হয়ে উঠার আর হয়নি তার। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
প্রায় একই পরিণতির হতে পারত সাংবাদিক, ব্যাংকার ও সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সদস্য মতিউল বারি চৌধুরীর। সিসিক’র মরণফাঁদে রিকশা উল্টে পড়েছিলেন তিনি। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিজের বাসায় বিশ্রামে থাকলেও বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারতো।
ঘটনা সোমবার রাতের। রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মতিউল বারি চৌধুরী। নগরীর শিবগঞ্জ সেনপাড়ার রাস্তা কেটে করা ছোটে নালায় রিকশার চাকা হঠাৎ আটকে গেলে ছিটকে পড়েন তিনি। হাত, পিঠ এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে জখম নিয়ে ছুটে যান চিকিৎসার জন্য। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন বাসায় অবস্থান করলেও এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানিয়েছেন, সারা শরীরে ব্যথা আর জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ে সমালোচনা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু এতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের। একবার উন্নয়ন কাজ শুরু হলে তা আর শেষ হতে চায়না। এমন কচ্ছপ গতির কাজে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শুধুই কি দুর্ভোগ! প্রাণ পর্যন্ত যাচ্ছে। কবি আব্দুল বাসিত মোহাম্মদের মৃত্যুতো হয়েছে, আরও অন্তত শতাধিক মানুষ মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সাংবাদিক ব্যাংকার মতিউল বারি চৌধুরী।
মঙ্গলবার বিকেলে সরজমিনে নগরীর শিবগঞ্জ এলাকায় গেলে দেখা যায়, শিবগঞ্জ-খরাদিপাড়া রাস্তা থেকে সেনপাড়া রাস্তায় প্রবেশের পর প্রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত রাস্তার এখানে ওখানে এবড়ো থেবড়োভাবে রাখা কংক্রিট, বালু, ইট পাথরসহ আরও নানা ধরনের নির্মাণ সামগ্রী। রাস্তার দু’দিকেই খোলা ড্রেন যেনো মৃত্যুকে আহ্বান করছে। এরমধ্যে আবার এলোমেলোভাবে নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখায় রাস্তাটি এতই সংকোচিত হয়েছে যে রিকশায় চলাচল করতেও প্রয়োজন পড়ে বাড়তি সতর্কতার। তবে বিদ্যুৎ চলে গেলে গোটা রাস্তাটাই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
এলাকাবাসীর সাথে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, ছোটোখাটো দুর্ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু শেষ হওয়ার কোন নাম নেই। বারবার তাগাদা দিলেও কেউ কারও কথা শুনছেনা। বিশেষ করে যারা কাজ করছেন, সেই কন্ট্রাক্টর টিকাদারদের যেনো কোন দায়-দায়িত্বই নেই যেনো। তারা যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রেখে রাস্তাটিকে মরণফাঁদে পরিণত করেছেন। এমনকি, কোথাও কোন বিপদ সংকেত বা লাল নিশানাও কেউ দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনা। তবে মতিউল বারি যে নালায় পড়েছিলেন, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর মঙ্গলবার সেই নালাটি ভরাট করেছেন করিতকর্মা কর্তারা। একটা লাল কাপড়ও সেখানে টানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাঙ্গাত্মক লেখা পোস্ট করে মনের খেদ প্রকাশ করছেন সচেতনদের কেউ কেউ। তেমনি এক ফেসবুক ব্যবহারকারী আলী ওয়াসেকুজ্জামান চৌধুরী গত ১০ ফেব্রুয়ারি তার টাইমলাইনে একটা পোস্টে লিখেছেন, ২০২০ সালে ড্রেন ও রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছিল আমাদের মহল্লায়। মাশা আল্লাহ, সিটি করপোরেশন সুন্দর তত্বাবধান করে ২০২৩ সালে এসেও রাস্তার কাজ প্রায় ২৫ ভাগের মত সম্পন্ন করতে পেরেছে। অবশ্য ড্রেন প্রায় শতভাগ। আমরা ভাঙ্গা রাস্তায় নানা কায়দা কানুন করে চলতে শিখেছি। আশা করি ২০২৫ সালের মধ্যে এই মহা পরিকল্পনা শেষ হবে। মোটামুটি পদ্মা সেতুর মত টাইমলাগা এই শিবগঞ্জ-দক্ষিণ বালুচর সড়কটির দৈর্ঘ্য ১.৫ কিলোমিটার।
তিনি এভাবেই বারবার ফেসবুকে লিখে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সিসিক কর্তারা যেনো কুম্ভকর্ণের নিদ্রায়।
এইভাবে সচেতন মহল নিজেদের খেদ রাগ ও দুর্ভোগের কথা প্রকাশ করলেও টনক নড়েনা সিলেট সিটি করপোরেশনের। জনগনের কষ্ট আর দুর্ভোগের ব্যাপারে ভাবতে তাদের বয়েই গেছে- ভাবখানা অনেকটা এরকম।
আর তাই এ ব্যাপারে কথা বলতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর মোবাইলে কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি। রিসিভ করেন নি প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানও।
তবে অনেক চেষ্টায় আলাপ করা সম্ভব হয় এই রাস্তার কন্ট্রাক্টর হিসাবে পরিচিত হিফজুলের সাথে। রাস্তার কন্ট্রাক্টর তিনি নয়- জানিয়ে বলেন, এখানে কাজ হচ্ছে তিন পর্যায়ের। ড্রেন, রাস্তা সংস্কার ও এবং বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের। আমি কেবল ড্রেনের কাজ করছি, তাও ঢাকার একজনের লাইসেন্সে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।
তবে রাস্তার কাজ যিনি করছেন, সেই কন্ট্রাক্টরের নাম বা মোবাইল নম্বর দিতেও তিনি অস্বীকার করেছেন।
খোঁজ নিযে জানা গেছে, কেবল সেনপাড়া রাস্তাই নয়, একই অবস্থা খরাদিপাড়া, মনিপুরিপাড়া, মজুমদারপাড়া, আদিত্যপাড়া, দেবপাড়াসহ গোটা শিবগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন পাড়ামহল্লার।
এদিকে সাংবাদিক মতিউল বারি চৌধুরী আহতের খবর জানতে পেরে মঙ্গলবার সকালে সেনপাড়া রাস্তাটি পরিবদর্শন করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানার এএসআই গফ্ফার। তিনি এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, ঘটনা সত্য। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে এবং তদন্তে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার বিষয়টি প্রমাণ হলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। আমরা আহত সাংবাদিকের বড় ভাই এবং স্থানীয়দের এ কথা জানিয়ে এসেছি।