• ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১লা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৪শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ: বর্তমান উন্নয়ন প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

admin
প্রকাশিত মার্চ ১৭, ২০২২
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ: বর্তমান উন্নয়ন প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

আল-আমিন:: 

আমার অহংকার হয়, আমি গর্ব করি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ তথা জন্মশতবার্ষিকী দেখার সুভাগ্য আমার হয়েছে। শত বছর আগে এই মহানায়কের আগমনের ফলে অর্ধশত বছর আগে আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাল সবুজের পতাকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। ২০২০-২০২১ বছরব্যাপী কোটি বাঙালি মহাউৎসবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছে।

আজকের বাংলাদেশ যুদ্ধময় অতীত বাংলাদেশকে ভুলে এখন সম্ভাবনাময় আগামী বাংলাদেশের পথে উন্নয়নের মহাসড়কে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছে। ১৭ মার্চ ২০২০ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বছর পূর্ণ হয়েছে। ফলে ২০২০-২০২১ সালকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য এসময়টি আমাদের কাছে তাৎপর্য বহন করেছে।

বাংলাদেশ মুজিব জন্মশতবর্ষে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বৃদ্ধি এ তিনটি সূচকের মানদন্ডে বাংলাদেশ উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে মানদন্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় এবং মুজিব জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সাফল্য এসেছে দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দিয়ে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ণ, একশতটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের বৃহৎ প্রকল্পসমূহ।

বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ণ করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১’। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। উপজেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ণ করা হয়েছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। জাতীয় শিশু নীতি-২০১১ প্রণয়ণের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দুঃস্থ, এতিম, অসহায় পথ শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সাউথ সাউথ এওয়ার্ডে ভূষিত হন।

বাংলাদেশ পোশাকশিল্পে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎতর দেশের তালিকায়। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়ণে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে আশি ভাগের বেশি নারী। বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে সকল নাগরিকের হাতে মোবাইল ফোন। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

বর্তমানে বিশ্বের একশত সাতান্নটি দেশে বাংলাদেশের প্রায় নব্বই লক্ষেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের বিভাগীয় শহরে শাখা স্থাপন করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদেশ গমনেচ্ছুক জনগণকে রেজিস্ট্রেশন করে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এ সেবা গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে হয়রানি ছাড়াই স্বল্পব্যয়ে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমিক যেতে পেরেছে। বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ জমাসহ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোজন।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ঔষুধ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ঔষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম রয়েছে। হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি বিস্তৃত করতে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতার হার ব্যাপক বৃদ্ধি করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতাভুক্ত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার কাজে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও গোষ্ঠীর চাপ সত্ত্বেও শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার শেষে রায় কার্যকর করা হয়েছে। এই বিচার এবং কার্যকর সম্পন্ন করা ছিল বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় সাফল্য। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরে ডিজিটাইজেশনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ভূমি ব্যবস্থা ডিজিটাইজেশনের ফলে মানুষের দুর্ভোগ কমেছে। ই-টেন্ডারিং, ই-জিপির ফলে দুর্নীতি কমেছে। এখন দশ টাকায় কৃষক ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। স্বাধীনতার পরপর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা ছিল বাংলাদেশের এই সরকারের বড় অর্জন। চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও সংস্থা এই ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ উপাধি। তলাহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ তের লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার দায়িত্বও পালন করে সুনাম কুঁড়িয়েছে।

একাত্তরের বিজয় ছিল এ জাতির চার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে জাতির জন্য বিজয় এনে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছেন। একটি নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরির ইতিহাস রচনা করেছেন। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্র উচ্চারণে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানে বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আর ইহা সম্ভব হয়েছে এদেশের জনগণের সাহস ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক